মোগল দরবারে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের উদ্ভব | Emergence of Clan Conflicts in Mughal Era

মোগল দরবারে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের উদ্ভব

 

মোগল দরবারে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের উদ্ভব | Emergence of Clan Conflicts in Mughal Era


মোগল সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ ছিল মোগল অভিজাত শ্ৰেণী। প্রকৃতপক্ষে তারাই দেশ শাসন করত। মোগল শাসনের প্রথম দিকে আবদুর রহমান, মহাবৎ খাঁ, সাদুল্লা, মীরজুমলা প্রভৃতি অভিজাতগণ সাম্রাজ্যের সকল শক্তির উৎস ছিলেন। ঔরঙ্গজেবের আমলে তুরানী, ইরানী, আফগান, ভারতীয় মুসলমান, রাজপুত, দক্ষিণী ও মারাঠাদের নিয়ে মোগল অভিজাত সম্প্রদায় গঠিত ছিল। 


মধ্য এশিয়ার তুর্কী-ভাষী অঞ্চল থেকে আগতদের বলা হত তুরানী। পারস্য, আফগানিস্তান ও ইরাকের পারসিক ভাষাভাষী অভিজাতদের বলা হত ইরানী। তুরানী ও ইরানীদের মধ্যে এমনিতেই রেষারেষি ছিল। এছাড়া, তুরানীরা সুন্নী ও ইরানীরা শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ায় তাদের মধ্যে ধর্মীয় বিরোধ প্রকট হয়ে ওঠে। ভারতীয় মুসলমানদের ‘শেখজাদা’ বলা হত। 


ঔরঙ্গজেব তাদের সন্দেহের চোখে দেখতেন এবং এই কারণে ঔরঙ্গজেবের আমলে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সংখ্যা যথেষ্ট হ্রাস পায়। দাক্ষিণাত্যে বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা রাজ্য জয়ের পর ঔরঙ্গজেব ঐ দু'টি রাজ্যের কিছু কর্মচারীকে রাজপদে নিযুক্ত করেন। তাদের ‘দক্ষিণী’ বলা হত। তাদের অনেককে দাক্ষিণাত্যে জায়গীর দেওয়া হয়। 

সেখান থেকে পূর্ণ মাত্রায় রাজস্ব আদায় করা যেত না এবং এই কারণে তাদের অবস্থা শোচনীয় ছিল। তাদের মধ্যে অনেকে আবার উত্তর ভারতে জায়গীর পেয়েছিল এবং তা ইরানী-তুরানী অভিজাতদের স্বার্থ বিঘ্নিত করে। এই কারণে তারা বিদেশী অভিজাতগোষ্ঠীর ঈর্ষা ও বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠে। মারাঠী বীর শিবাজীর সংগ্রামকে খর্ব করার উদ্দেশ্যে ঔরঙ্গজেব বেশ কিছু মারাঠা-কে মনসবদার করেন। 


বলা বাহুল্য, বিদেশী অভিজাতরা এ জিনিস মেনে নিতে পারেনি, কারণ এই সব নবাগতদের আগমনে তারাই সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এইভাবে নানা জাতি ও ধর্মের মানুষ নিয়ে গঠিত অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষ দেখা দেয়। জায়গীরদারী সংকট এই বিদ্বেষ ও দলাদলিকে তীব্রতর করে তোলে, যার ফলে সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে এক গভীর সংকটের সৃষ্টি হয়। ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র রচিত ‘মোগল দরবারে দল ও রাজনীতি' ('Parties and Politics at the Mughal Court') গ্রন্থে এই গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের বিস্তৃত বিবরণ আছে। 


ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে ইরানী দলের নেতা ছিলেন আসাদ খাঁ ও জুলফিকার খাঁ। তাঁরা যথাক্রমে ‘ওয়াজীর’ ও ‘মীর বক্সী’ নামে দু'টি সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদে নিযুক্ত ছিলেন। এই দলের অন্যান্য নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন দায়ুদ খাঁ পন্নী, দলপৎ রাও বুন্দেলা ও রাম সিংহ হারা। অপর দিকে তুরানী দলের নেতৃত্বে ছিলেন হাজীউদ্দিন ফিরোজ জড্ ও আমিন খাঁ। ঔরঙ্গজেব আমিন খাঁ-কে ‘সদর’ পদে নিযুক্ত করেন। 


এই দলের অন্যান্য নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন হাজীউদ্দিন ফিরোজ জঙের পুত্র চিন্ কিলিচ খান ও হামিদ খাঁ। ঔরঙ্গজেবের আমলে তুরানী দলের প্রতিপত্তি কম ছিল। তাঁর রাজত্বকালে বিভিন্ন সময়ে দুই গোষ্ঠীকেই যুদ্ধের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দাক্ষিণাত্য সম্পর্কে দুই গোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গিতে যথেষ্ট পার্থক্য ছিল। ইরানী দলনেতা জুলফিকার খাঁ দাক্ষিণাত্যে আপোসের পক্ষপাতী ছিলেন। অপরপক্ষে, তুরানীরা দাক্ষিণাত্যে দৃঢ় ও অনমনীয় নীতি গ্রহণে ইচ্ছুক ছিল।


কাফি খাঁ লিখছেন যে, এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফলে ঔরঙ্গজেবের পরিকল্পনাগুলি সফল হয়নি বা সফল হতে বিলম্ব ঘটে। সম্রাটের পক্ষে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার নিরসন করা সম্ভব হয়নি বা ইচ্ছে করেই তিনি তা করেননি, কারণ তিনি নিজেই এক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অন্যকে ব্যবহার করতেন। ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকার-এর মতে, “মোগল ইতিহাসের চিন্তাশীল ছাত্রের কাছে অভিজাত সম্প্রদায়ের অধঃপতনের মত গুরুতর বিষয় আর কিছু নেই।” 


ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্র লিখছেন যে, ক্ষমতা অধিকারের জন্য এইসব অভিজাতরা বলপ্রয়োগ, জালিয়াতি ও বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিতেও কুণ্ঠিত হতেন না। পারস্পরিক হানাহানির ফলে সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থা ও সংহতি শিথিল হয়ে তা খণ্ডবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সংহতির অভাবে শাসনব্যবস্থা তার প্রতিরোধ শক্তি হারিয়ে বিদেশী আক্রমণের সহজ শিকারে পরিণত হয়।


তথ্য সূত্র:

স্বদেশ পরিচয়-জীবন মুখোপাধ্যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

World News

نموذج الاتصال

×