ঔরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতি সম্পর্কে আলোচনা করো | Religious Policy Aurangzeb

ঔরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতি

 

ঔরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতি সম্পর্কে আলোচনা করো | Religious Policy Aurangzeb


১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালেই মোগল সাম্রাজ্যের পতনের সূচনায় হয় এবং এর জন্য দায়ী ছিল সম্রাটের অনুসৃত ভ্রান্ত ও অবাস্তব নীতি। ঐতিহাসিক বিপানচন্দ্র লিখেছেন, " ঔরঙ্গজেবের দীর্ঘস্থায়ী ও দৃঢ় শাসনকালেই মুঘল সাম্রাজ্যের ঐক্য ও স্থায়িত্বের ভিত্তি কেঁপে উঠেছিল।" ধর্মীয় সহনশীলতা ও সকল সম্প্রদায়ের প্রতি সমধর্মী নীতি গ্রহণ করে হিন্দু-মুসলিম সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ভারতবর্ষে একটি 'জাতীয় রাষ্ট্র' গঠন করায় ছিল আকবরের উদ্দেশ্য। আকবর, জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের রাজত্বকাকে মোগল সাম্রাজ্যকে মোটামুটিভাবে 'ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র' বলে অভিহিত করা যায়। 


অপরপক্ষে, ঔরঙ্গজেবের লক্ষ্য ছিল ভারতবর্ষকে 'ঐস্লামিক রাষ্ট্র' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। তিনি আকবর অনুসৃত উদারতার পরিবর্তে সংকীর্ণতা ও পরধর্মসহিষ্ণুতার পরিবর্তে পরধর্মবিদ্বেষ ও ধর্মান্ধতা এবং প্রজাবর্গের প্রতি সম-ব্যবহারের পরিবর্তে অ-মুসলমানদের প্রতি নির্যাতন ও বঞ্চনার নীতি গ্রহণ করে সমগ্র হিন্দু সম্প্রদায়কে মোগল সাম্রাজ্যের ঘোরতর শত্রুতে পরিণত করেন। আকবরের সহৃদয় উদার নীতির ফলে রাজপুতরা মোগল সাম্রাজ্যের শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত স্তম্ভে পরিণত হয়, কিন্তু মাড়োয়ারকে ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে গিয়ে ঔরঙ্গজেব রাজপুত জাতিকে শত্রুতে রূপান্তরিত করেন। 


এর ফলে তিনি রাজপুতদের সামরিক সাহায্য থেকে বঞ্চিত হন। তাঁর অনুদার নীতির ফলে পাঞ্জাবের শিখরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। জমিদার, ওমরাহ ও দরবারের সামন্ততান্ত্রিক নীতির ফলে সতনামী, জাঠ ও বুন্দেলা কৃষকরা বিদ্রোহে সামিল হয়। এছাড়া নানাস্থানে হিন্দু রাজা, কৃষক, জমিদার ও কারিগরেরা এই বিদ্রোহে সামিল হয়। ভূমি-রাজস্বের উচ্চ হার, কর্মচারীদের দ্বারা আরোপিত নানা ধরনের বেআইনী কর এবং তা আদায়ের জন্য নানা অত্যাচার কৃষকদের বিক্ষুদ্ধ করে তোলে। কৃষকদের উৎপন্ন শস্যের একটি বিরাট অংশ এইসব বেআইনী কর মেটাতে চলে যেত। 


সম্রাটরা নির্দেশ জারী করেও এই বে-আইনী আদায় বন্ধ করতে পারেননি। ভূমি-রাজস্বের হার উচ্চ হওয়ায় কৃষকরা তা না দেবার চেষ্টা করত। অষ্টাদশ শতকের শাসকশ্রেণীর এক বিশিষ্ট ব্যক্তি শাহ ওয়ালিয়া লিখেছেন—“কৃষক, বণিক ও কারিগরদের ওপর প্রচণ্ড কর চাপান হচ্ছে এবং তা আদায়ের জন্য অত্যাচার করা হচ্ছে। একমাত্র করভার কমালেই দেশে শান্তি ফিরে আসবে।” বলা বাহুল্য, দেশে আর শাস্তি ফিরে আসেনি—বরং তাঁর আমলে দেশে এমন ব্যাপক ও সর্বব্যাপী বিদ্রোহ দেখা দেয়, যা পূর্বে আর কখনও সংঘটিত হয়নি। এর ফলে সাম্রাজ্যের পতন যে অনিবার্য হয়ে পড়ে সে সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। 


ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব জমিদার ও কৃষকদের প্রতিরোধ আন্দোলনকেই পতনের প্রধান কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। মারাঠাদের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে অস্বীকার করে তিনি তাদের বিরুদ্ধে এক দীর্ঘস্থায়ী অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে সাম্রাজ্যকে দ্রুত পতনেব দিকে ঠেলে দেন। দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে মারাঠাদের যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে সাম্রাজ্যকে দ্রুত পতনের দিকে ঠেলে দেন। 


দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থেকেও দাক্ষিণাত্যে তিনি কোন প্রকার সাফল্য অর্জন করতে পারেন নি—বরং বিপরীতভাবে এই নিষ্ফলা যুদ্ধই সাম্রাজ্যের পতনকে সুনিশ্চিত করে তোলে। যুদ্ধের ফলে রাজকোষের অর্থ জলের মত ব্যয়িত হয়, দাক্ষিণাত্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে, দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে উত্তর ভারতে সম্রাটের অনুপস্থিতির ফলে শাসনব্যবস্থায় চরম অরাজকতা দেখা দেয়, বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ ও অশান্তি শুরু হয় এবং সরকারী নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ে। 

হতাশাগ্রস্থ বৃদ্ধ সম্রাট ঔরঙ্গজেব তাঁর পুত্র আজম-কে লিখছেন—“আমি একা এসেছিলাম, একাই চললাম। দেশ ও জনসাধারণের জন্য ভাল কিছু করতে পারিনি, ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও আমি হতাশ।” বলাবাহুল্য, ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরেও উত্তর ভারত ও দাক্ষিণাত্যের এই বিদ্রোহী শক্তিগুলিকে দমন করা বা সমদর্শী নীতি গ্রহণ করে বিক্ষুব্ধ হিন্দুদের সন্তুষ্ট করা সম্ভব হয়নি।


তথ্য সূত্র:

স্বদেশ পরিচয়-জীবন মুখোপাধ্যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

World News

نموذج الاتصال

×