ভূমিকা:
বিজয়নগরের নরপতিরা এক সুষ্ঠ শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। শাসনব্যবস্থায় রাজাই ছিলেন সর্বেসর্বা। শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ, সমর বিভাগ—সব কিছুর সর্বেসর্বা হলেও রাজা কিন্তু কখনই স্বৈরাচারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন প্রজাহিতৈষী। ধর্মশাস্ত্র অনুসারে তিনি দেশ শাসন করতেন। রাজা কৃষ্ণদেব রায় তাঁর ‘আমুক্ত-মাল্যদা’ গ্রন্থে বলেছেন যে, “ধর্মের প্রতি লক্ষ্য রেখে রাজ্যশাসন করাই রাজার কর্তব্য।” শাসনকার্যে রাজাকে সাহায্য করার জন্য একটি মন্ত্রিসভা ছিল এবং মন্ত্রিগণ রাজা কর্তৃক নিযুক্ত ও পদচ্যুত হতেন। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য—এই তিন শ্রেণী থেকে মন্ত্রী নিযুক্ত করা হত। মন্ত্রী-পদ অনেক সময় বংশানুক্রমিকও হত। মন্ত্রী ব্যতীত কোষাধ্যক্ষ, বাণিজ্য সচিব, পুলিশ বাহিনীর অধিনায়ক, অশ্ববাহিনীর অধিনায়ক প্রভৃতি বিভিন্ন রাজকর্মচারীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
বিজয়নগরের রাজারা একটি জাঁকজমকপূর্ণ রাজসভা স্থাপন করেছিলেন। এই সভা বহুসংখ্যক পণ্ডিত, পুরোহিত, সাহিত্যিক, জ্যোতিষী ও সংগীতজ্ঞ দ্বারা অলংকৃত ছিল। পারস্যের রাজদূত আবদুর রজ্জাক ও পর্তুগীজ পর্যটক নুনিজ বিজয়নগরে একটি ‘মহাকরণ’-এর কথা উল্লেখ করেছেন।
১. প্রাদেশিক শাসন:
শাসনকার্যের সুবিধার জন্য সমগ্র সাম্রাজ্য কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের ‘নায়ক’ বা ‘নায়েক’ বলা হত এবং সাধারণত তাঁরা রাজপরিবার ও অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্য থেকেই নিযুক্ত হতেন। তাঁদের প্রত্যেকের নিজস্ব রাজসভা ও সেনাবাহিনী ছিল। প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে নিজ নিজ এলাকায় শাসনকার্য পরিচালনা করলেও কেন্দ্রের সঙ্গে সর্বদাই তাঁদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলতে হত। প্রদেশগুলি জেলা এবং জেলাগুলি আবার গ্রাম-এ বিভক্ত ছিল। গ্রাম ছিল শাসনব্যবস্থার সর্বনিম্ন স্তর। গ্রামগুলি সুশাসন ভোগ করত এবং সেখানে পঞ্চায়েতএর ওপর গ্রামের পুলিশ, বিচার ও শাসনভার ন্যস্ত ছিল। ‘মহানায়কাচার্য’ নামে এক শ্রেণীর কর্মচারী গ্রামের শাসনকার্য এদারক করতেন এবং তাঁর মাধ্যমেই কেন্দ্রীয় সরকার গ্রামগুলির ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতেন।
২. রাজস্ব:
খেয়া, পথ-কর, শিল্প-কর, বিবাহ-কর, গোচারণ-কর প্রভৃতি থেকে যথেষ্ট রাজস্ব আদায় হলেও ভূমি-করই ছিল সরকারী আয়ের প্রধান উৎস। জমির উৎপাদিকা শক্তি অনুসারে ভূমি-রাজস্ব নির্ধারিত হত। উৎপন্ন শস্যের এক-ষষ্ঠাংশ ভূমি-রাজস্ব হিসেবে গৃহীত হত। অর্থ বা শস্য দ্বারা রাজস্ব দেওয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল। রাজস্ব সংক্রান্ত সকল কার্য পরিচালনার জন্য একটি পৃথক দপ্তর ছিল।
৩. সামরিক বিভাগ:
পদাতিক, অশ্বারোহী, গোলন্দাজ, উষ্ট্র ও হস্তিবাহিনী নিয়ে সরকারের সেনাবাহিনী গঠিত ছিল। বিজয়নগর সম্রাজ্যের সেনাবাহিনী ছিল বিশাল। কৃষ্ণদেব রায়ের সেনাবাহিনীতে ৭ লক্ষ পদাতিক, ৩৬০০-টি অশ্ব ও ৬৫০-টি হস্তী ছিল। এ সময় গোলন্দাজ বাহিনীরও উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘দণ্ডনায়ক’ উপাধিকারী প্রধান সেনাপতির ওপর সেনাবাহিনীর দায়িত্ব অর্পিত ছিল।
৪. বিচার:
রাজাই ছিলেন দেশের সর্বোচ্চ বিচারক ও আইন প্রণেতা। অন্যান্য বিচারকগণ রাজা কর্তৃক মনোনীত হতেন। প্রজাদের সুবিধার্থে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে তিনি বহু বিচারালয় স্থাপন করেন। গ্রামাঞ্চলে পঞ্চায়েতের ওপর বিচারের ভার ন্যস্ত ছিল। দেশে দণ্ডবিধি ছিল খুবই কঠোর। দোষী ব্যক্তির জরিমানা ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হত। অপরাধীর অঙ্গছেদ— এমনকি প্রাণদণ্ডও প্রচলিত ছিল।
শাসন ব্যবস্থার ত্রুটি:
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থা ত্রুটিহীন ছিল না। (১) প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও সামন্তপ্রভুদের হাতে প্রভূত ক্ষমতা থাকায় কেন্দ্রীয় সরকার দুর্বল হয়ে পড়ে। দুর্বল সম্রাট সিংহাসনে বসলেই তারা স্বাধীনতা ঘোষণার সুযোগ খুঁজত। (২) তাদের সামরিক ব্যবস্থা ছিল ত্রুটিপূর্ণ কারণ সাধারণভাবে সামন্তপ্রভুরাই যুদ্ধের সময় সেনা পাঠিয়ে রাজাকে সাহায্য করত এবং এর ফলে রাজা সম্পূর্ণভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিলেন। (৩) প্রচুর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বিজয়নগরের শাসকবর্গ ভারতের অভ্যন্তরে বাণিজ্য-বিস্তারের কোন চেষ্টা করেন নি—তাঁদের অর্থনীতি কৃষি-সম্পদের ওপর নির্ভরশীল ছিল। (৪) অধিক শুল্ক লাভের আশায় তাঁরা ভারতের পশ্চিম উপকূলে পর্তুগীজদের বসবাসের সুযোগ করে দেন—যা পরবর্তীকালে মারাত্মক বলে পরিগণিত হয়।
তথ্য সূত্র:
স্বদেশ পরিচয় | জীবন মুখোপাধ্যায়।