প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ | প্রথম মহাযুদ্ধের কারণ | প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি | প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কেন হয়েছিল | প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট | প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা কিভাবে হয়েছিল
ভূমিকা:
আধুনিক সভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম এক মর্মান্তিক ঘটনা হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪ খ্রি.)। বিশ্বের বেশিরভাগ বা পরােক্ষভাবে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। সমকালীন ইউরােপের বেশ কিছু ঘটনা এই বিশ্বযুদ্ধ ঘটায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ | পটভূমি
১. অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদ:
ফরাসি বিপ্লবের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইউরােপের দেশগুলি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু ভিয়েনা সম্মেলন (১৮১৫ খ্রি.) সেই চেষ্টায় বাধা হয়ে দাঁড়ালে ইউরােপীয় জাতিগােষ্ঠীগুলি এর প্রতিবাদে সােচ্চার হয়ে ওঠে।আলসাস ও লােরেন অঞল দুটি ফরাসিদের থেকে, ট্রেনটিনাে ও ট্রিয়েস্ট অঞ্চল দুটি ইতালীয়দের থেকে, শ্লেজউইগ অঞ্চলটি ডেনমার্কের অধিবাসীদের থেকে কেড়ে নেওয়া হলে তারা ক্ষুদ্ধ হয়।
২. উগ্র জাতীয়তাবাদ :
উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ইউরােপের বিভিন্ন দেশে এক ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদের আবির্ভাব ঘটে। এই সময়কালে বিভিন্ন জাতি নিজের দেশ ও জাতির শ্রেষ্ঠত্ব এবং অন্যান্য জাতির প্রতি বিদ্বেষমূলক প্রচার শুরু করে। জার্মানরা টিউটন জাতির, ইংরেজরা অ্যাংলাে-স্যাক্সন জাতির, ফরাসিরা ফরাসি-লাতিন জাতির শ্রেষ্ঠত্বের প্রচার করলে যুদ্ধের পরিবেশ তৈরি হয়।
৩. ঔপনিবেশিক সংঘাত :
শিল্পবিপ্লবের ফলে ইউরােপের বিভিন্ন দেশে শিল্পজাত পণ্যের উৎপাদন প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। প্রয়ােজনের অতিরিক্ত পণ্য বিক্রির জন্য এবং কাঁচামালের জোগানের জন্য নতুন নতুন বাজার তথা উপনিবেশ দখলের প্রয়ােজন দেখা দেয়। এই কারণেই আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের অন্তর্গত বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ গড়ে ওঠে। ইউরােপীয় রাষ্ট্রগুলি এই উপনিবেশ বিস্তারকে কেন্দ্র করে পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
রুশ বিপ্লবের কারণ- দেখুন
৪. দুই শক্তিজোটের উদ্ভব:
আদর্শগত কারণে সমগ্র ইউরােপ দুটি আলাদা শক্তিজোটে ভাগ হয়ে যায়। একদিকে থাকে জার্মানি, ইতালি, অস্ট্রিয়ার ত্রিশক্তি মৈত্রী বা ট্রিপল অ্যালায়েন্স (১৮৮২ খ্রি.) এবং অন্যদিকে থাকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়ার ত্রিশক্তি আঁতাত জোট (১৯০৭ খ্রি.)। এই দুই শক্তিজোটের পরস্পরবিদ্বেষী মনােভাবের কারণে বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
৫. সামরিক প্রতিযােগিতা :
সামরিক বিভাগকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বেশিরভাগ ইউরােপীয় দেশেই সামরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। শক্তিজোটের অন্তর্গত দেশগুলি পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাসের বশে সামরিক প্রতিযােগিতায় লিপ্ত হয়।
৬. বলকান সমস্যা :
বলকান জাতীয়তাবাদ ও স্লাভ আন্দোলন ইউরােপকে অগ্নিগর্ভ করে তােলে। বলকান অঞলে আধিপত্যের প্রশ্নে অস্ট্রিয়া ও সার্বিয়া, সার্বিয়া ও বুলগেরিয়া এবং অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাধে, যা সমগ্র পূর্ব ইউরােপকে অশান্ত করে এবং বিশ্বযুদ্ধে ইন্ধন জোগায়।
৭. আন্তর্জাতিক সংকট :
বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ঘটনাও প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে। উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার মরক্কোকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় মরক্কো সংকট। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে সৃষ্ট আগাদির সংকট জার্মানির সঙ্গে ইঙ্গ-ফরাসি সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। এইসব আন্তর্জাতিক সংকটগুলি যুদ্ধ-পরিস্থিতি তৈরি করে।
প্রত্যক্ষ কারণ—সেরাজেভাে হত্যাকাণ্ড : অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্কডিউক ফ্রান্সিস ফার্ডিনান্ড ও তাঁর পত্নী সােফিয়া বসনিয়ার রাজধানী সেরাজেভােতে ভ্রমণে এসে নিহত হন (১৯১৪ খ্রি., ২৮ জুন)। তাঁদের হত্যা করে স্লাভ সন্ত্রাসবাদী সংস্থা ব্ল্যাক হ্যান্ড বা ইউনিয়ন অব ডেথ'-এর সদস্য ন্যাভরিলাে প্রিন্সেপ। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সার্বিয়াকে দায়ী করে অস্ট্রিয়া এক চরমপত্র পাঠায়। ওই চরমপত্রে উল্লিখিত শর্তগুলি ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পূরণ করার জন্য দাবি জানায় অস্ট্রিয়া। সার্বিয়া অনেকগুলি দাবি মেনে নিলেও কয়েকটি দাবি মানতে অস্বীকার করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে অস্ট্রিয়া ২৮ জুলাই সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেড আক্রমণ করে। অস্ট্রিয়া ও সার্বিয়ার মধ্যে শুরু হওয়া এই যুদ্ধে একে একে বিভিন্ন দেশ অংশগ্রহণ করলে তা বিশ্বযুদ্ধের রূপ নেয়।
গ্রন্থপঞ্জি: ইতিহাস শিক্ষক (জে মুখোপাধ্যায়)