গৌতমীপুত্র সাতকর্নী- র অবদান ও কৃতিত্ব আলোচনা করো Gautamiputra Satakarni
খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে মহারাষ্ট্রে (মতান্তরে অন্ধ্রপ্রদেশ) সাতবাহন নামে এক নতুন রাজশক্তির অভ্যুদয় হয়। ক্ষুদ্র এক অঞ্চলের অধিপতি রূপে আত্মপ্রকাশ করে ধীরে ধীরে এই বংশের রাজারা পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের এক শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক শক্তিরূপে আবির্ভূত হন। ইতিহাসে এই রাজবংশ সাতবাহন বা সাতবাহন নামে প্রসিদ্ধ। সাতবাহন বংশের সর্বশেষ্ঠ রাজা ছিলেন গৌতমীপুত্র সাতকর্ণি (১০৬ - ১৩০ খ্রি:)। ধ্বংসপ্রায় মৌর্য সাম্রাজ্যের উপর তিনি তার দক্ষতা ও কার্যাবলীর মাধ্যমে সাতবাহন বংশকে একটি বৃহৎ শক্তিরূপে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
গৌতমীপুত্রের শাসনকালের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল নাসিক প্রশস্তি। গৌতমীপুত্রের মাতা গৌতমী বলশ্রী পুত্রের মৃত্যুর 19 বছর পরে এই লেখটি উৎকীর্ণ করেন। সন্তানহারা মাতার এই আর্তি ঐতিহাসিকদের কাছে অতি মূল্যবান। অসাধারণ সামরিক প্রতিভার অধিকারী গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী মহারাষ্ট্র ও সন্নিহিত অঞ্চলসমূহ পুনরুদ্ধার করে তিনি সাতবাহনদের লুপ্তগৌরব পুনরুদ্ধার করেছিলেন।
কেবলমাত্র মহারাষ্ট্র নয় তিনি শক, যবন ও পহ্লব দের সংহার করেছেন বলে নাসিক প্রশস্তিতে দাবি করা হয়েছে। নাসিক প্রশস্তিতে ঋষিক, মূলক, সৌরাষ্ট্র, অপরান্ত, অনুপ , বিদর্ভ, আকর এবং অবন্তী প্রভৃতি অঞ্চল গৌতমীপুত্রের রাজ্যভুক্ত বলা হয়েছে। উত্তরে গুজরাত ও মধ্যপ্রদেশ হতে দক্ষিণে কৃষ্ণা নদী এবং পূর্বে বিদর্ভ থেকে পশ্চিমে কোক্ষণ উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত ভূভাগের অধিপতি হলেন গৌতমীপুত্র দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে এত বড় রাজ্য এর আগে কখনও গড়ে ওঠেনি। ড: দীনেশচন্দ্র সরকারের মতে, তিনি বিন্ধের দক্ষিণস্ত সকল ভূভাগের অধিপতি ছিলেন।
কলিঙ্গের রাজা খারবেলের সঙ্গেও তাঁর সংঘাত দেখা দিয়েছিল। তিনি পশ্চিমের অধীশ্বর' এবং 'প্রতিষ্ঠান অধিপতি’ উপাধি ধারণ করেন। উত্তর-পশ্চিম দাক্ষিণাত্যে অবস্থিত বর্তমান পৈঠান বা তখনকার প্রতিষ্ঠান পুর সাতবাহন রাজধানী- রূপে প্রসিদ্ধি অর্জন করে। গৌতমীপুত্রের সামরিক সাফল্যের পরিচয় তাঁর নানান উপাধি ধারণের মধ্যে পাওয়া যায়। তাঁর 'ত্রি-সমুদ্রজয়ীতিয় পীতবাহন' , 'সাতবাহন-কুল-যশ-প্রতিষ্ঠাকর' উপাধি শক্তি ও অধিকারের সীমারেখার প্রতি ইঙ্গিত করে। বাস্তবেই দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসে গৌতমীপুত্রের শাসনকাল ছিল এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়।
জুনাগড় লেখ থেকে - সাতকর্ণির সঙ্গে রুদ্রাদামনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা জানা যায়। কানহেরি লেখ হতে জানা যায়, অনুমান আত্মরক্ষার তাগিদে গৌতমীপুত্র নিজ সন্তানের সঙ্গে রুদ্রদামনের কন্যার বিবাহ দেন। কেবল যোদ্ধা বা রাজ্যজয়ী রূপে নয়, সুশাসক রূপেও গৌতমীপুত্র তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। শাস্ত্রীয় বিধিপালন ও মানবিক বিবেচনা তাঁর শাসনব্যবস্থাকে প্রকৃত অর্থে জনহিতৈষী করে তোলে। বিনা কারণে কখনও তিনি করবৃদ্ধির চেষ্টা করেননি। তিনি ছিলেন বর্ণাশ্রম ধর্মের একান্ত সমর্থক। সংস্কারক হিসেবে তিনি ক্ষত্রিয়দের অহংকার চূর্ণ করার পাশাপাশি ব্রাহ্মণ শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করেছিলেন। নানা স্থাপত্যকীর্তির জন্যও তাঁর রাজত্বকাল বিখ্যাত। তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকীর্তি হল গোবর্ধন। জেলার বেনকটক নগরের প্রতিষ্ঠা।
পরিশেষে বলা যায়, রাজনৈতিক দিক দিয়ে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর অবদান ছিল দু - ধরণের - একদিকে বৈদেশিক শক্তিকে প্রতিহত করে নিরাপত্তা বিধান ও অন্যদিকে বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তিকে প্রতিহত করে সাতবাহন রাজ্যের সম্প্রসারণ। শাসক ও বিজেতা হিসেবে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছিলেন। প্রথম সাতকর্ণীর মৃত্যুর পর শক আক্রমণের ফলে সাময়িকভাবে সাতবাহন বংশের গৌরব ম্লান হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী এই লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধার করেছিলেন। এটিকেই ঐতিহাসিকরা গৌতমীপুত্রের সর্বাধিক গৌরবময় কৃতিত্ব বলে দাবী করেছেন।