শাহজাহানের মধ্য-এশিয়া নীতি আলোচনা করো | 4th Semester History Honours Suggestion | Calcutta University

4th Semester History Honours Suggestion | Calcutta University

শাহজাহানের মধ্য-এশিয়া নীতি আলোচনা করো | 4th Semester History Honours Suggestion | Calcutta University 


মধ্য-এশিয়া ছিল মুঘল সম্রাটের পূর্বপুরুষদের বাসভূমি। ফলে পূর্বপুরুষদের স্মৃতিবিজড়িত মধ্য এশিয়া সম্পর্কে মুঘল সম্রাটদের যথেষ্ট দুর্বলতা ছিল। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় দিক থেকে মুঘল সম্রাটরা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। শাহজাহানও তার পূর্বপুরুষদের বাসভূমি সমরখন্দ পুনরুদ্ধারের সংকল্প করেন। 

ঐতিহাসিক আব্দুল হামিদ লাহোরী লিখেছেন, "রাজত্বের গোড়া থেকে সম্রাটদের মন পড়েছিল বলখ্ ও বাদাখশান জয়ের দিকে।" প্রকৃতপক্ষে মধ্য এশিয়ার বলখ্ ও বাদাখশান অভিযানের পশ্চাতে তৈমুরের রাজধানী সমরখন্দ দখলের চাবিকাঠি নিহিত ছিল।" যদিও ড. ঈশ্বরীপ্রসাদের মতে, আবেগের থেকে সাম্রাজ্যের নিরাপত্তাবিধান ছিল শাহজাহানের মুখ্য উদ্দেশ্য।


সাম্রাজ্যবাদী শাসক হিসেবে শাহজাহান মুঘল সাম্রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধিতে সচেষ্ট ছিলেন। হুমায়ূন, আকবর এবং জাহাঙ্গীর মধ্য এশিয়ার অঞ্চলগুলি জয়ের স্বপ্ন দেখলেও তাদের অভিযান সফল হয়নি। অবশ্য শাহজাহান তার এই অভিযানের অজুহাত প্রসঙ্গে কাবুলে উজবেক্ উপজাতির আক্রমণকে ব্যবহার করেন। এইসময় বোখারা ও বালখের শাসনকর্তা নজর মহম্মদের স্বৈরাচারী শাসনের ফলে তার বিরুদ্ধে উজবেকী সর্দাররা বিদ্রোহ করে (১৬৪৫)।


এইসময় উজবেক্ নেতারা ক্ষমতার লোভে নানাভাবে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। এমতাবস্থায় তাদের এই বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে নজর মহম্মদ শাহজাহানের সাহায্যে প্রার্থনা করেন। পঞ্চাশ হাজার অশ্বারোহী ও দশহাজার পদাতিক বাহিনীসহ শাহজাহান তার কনিষ্ঠপুত্র মুরাদকে মধ্য এশিয়ায় মোগল কর্তৃত্ব স্থাপনের জন্য প্রেরণ করেন। তিনি বাদাখশান ও বালখ্ অধিকার করেন (১৬৪৬)। কিন্তু বিজিত অঞ্চলের উপর মোগল আধিপত্য সুসংহত করার পরিবর্তে আরামপ্রিয় মুরাদ মধ্য এশিয়ার অসুবিধাজনক আবহাওয়া এড়াবার জন্য ভারতবর্ষে ফিরে আসেন।


শাহজাহান মধ্য এশিয়ার দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার লাভের জন্য মুরাদকে স্থলে ঔরঙ্গজেব প্রেরণ করলেন (১৬৪৭)। উজবেক সৈন্যরা বিশিষ্ট যুদ্ধরীতি "Cossack Toctics" - এর সাহায্যে মুঘল বাহিনীকে যথেষ্ট প্রতিরোধের সম্মুখে ফেলে। ঔরঙ্গজেব বহুবাধা বিপত্তি সত্ত্বেও যুদ্ধ করলেন এবং একটি সরাসরি যুদ্ধে উজবেকদের পরাজিত করলেও কোনো প্রকৃত চূড়ান্ত ফল লাভ করা যায়নি। ইতিমধ্যে নজর মহম্মদ মোগলদের উদ্দেশ্য সমন্ধে সন্দিহান হয়ে পারস্যে পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং পারস্যের অধিপতি শাহের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। 


সামরিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি মুঘলদের প্রতিকূল ছিল। মধ্য এশিয়ার কঠোর আবহাওয়া আরামপ্রিয় মুসলমান অভিজাতকের পক্ষে কষ্টকর হয়ে উঠেছিল। এদিকে ঔরঙ্গজেব উজবেকদের হঠিয়ে বালখ অধিকার করে রাজপুত মধুসিং হাড়াকে শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ করেন। তথাপিও মধ্য এশিয়ার কষ্টকর আবহাওয়া মোগল সেনারা আর থাকতে রাজি না হওয়ায় ঔরঙ্গজেব বালখ্ থেকে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন। 

নজর মহম্মদকেই তার রাজ্য স্বীকারের বিনিময়ে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে শাহজাহান তার পুত্র ঔরঙ্গজেবকে নির্দেশ করেন। কিন্তু নজর মহম্মদ নিজে সাক্ষাৎ না করায় ঔরঙ্গজেব নজর মহম্মদের বৈচিত্র্যকে বশ্যতা স্বীকারের বিনিময়ে বালখ্ ফেরত দিয়ে স্বদেশের দিকে রওনা দেন। পথে হাজার উপজাতির আক্রমণে মোগল বাহিনীর বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়। শেষপর্যন্ত সামান্য কিছু সৈন্য নিয়ে তারা দেশে ফিরে আসে। 


ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ শাহজাহানের মধ্য এশিয়া অভিযানকে সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব ও ভাবাবেগ প্রসূত বলে বর্ণনা করেছেন। তার মধ্য এশিয়া অভিযানের উদ্দেশ্য ও অভিযান কর্মসূচির যৌক্তিকতা সম্পর্কে অধিকাংশ ঐতিহাসিক মুঘল বাদশাহ ও অভিজাতবর্গের যুক্তিহীনতা ও অদূরদর্শিতার অভিযোগ এনেছেন। ঐতিহাসিক আতাহার আলীর মতে, ভূ-সামরিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের দিকে শাহজাহানের অভিযানের যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকরা শাহজাহানের অভিযানকে নেহাতই "আকস্মিক ও পূর্ব-পরিকল্পনা রহিত" বলে বর্ণনা করেছেন।


একথা অনস্বীকার্য যে, শাহজাহান উত্তর-পশ্চিমে কাবুল থেকে কান্দাহার পর্যন্ত এলাকায় মুঘল সীমানা সুরক্ষিত করার তাগিদেই বালখ্ অভিযান করেন। একই উদ্দেশ্যে উজবেকদের দমনও প্রয়োজন ছিল। কিন্তু শাহজাহান সফল হতে পারেননি। এক্ষেত্রে দূরত্ব ও যাতায়াত ব্যবস্থার অসুবিধা এবং অস্বাস্থ্যকর জলবায়ু শাহজাহানের অভিযানের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করা হয়। 

এই প্রসঙ্গে স্যার যদুনাথ সরকার বলেছেন যে, "দরবারে সম্রাট রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ভুলে এই অভিযানের গহ্বরে ঝাঁপিয়ে পড়েন।" কিন্তু শেষপর্যন্ত তার অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং পিতৃভূমি পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বপ্ন শাহজাহানের অধরাই থাকলো। এককথায় শাহাজানের মধ্য এশিয়া নীতি ছিল তার সাম্রাজ্যবাদের "শেষ হংস সঙ্গীত"


তথ্য সূত্র:

১. মুঘল-রাজ থেকে কোম্পানি রাজ- অধ্যাপক গোপালকৃষ্ণ পাহাড়ী।

২. মুঘল যুগ থেকে কোম্পানি আমল- সৌমিত্র শ্রীমানী। 

৩. ভারতের ইতিহাস- মুঘল যুগ থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণ- তেসলিম চৌধুরী।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

World News

نموذج الاتصال

×