জন লক কিভাবে উদারনৈতিক রাষ্ট্রের রূপরেখা তৈরি করেছিলেন | History Honours | Calcutta University

জন লক কিভাবে উদারনৈতিক রাষ্ট্রের রূপরেখা তৈরি করেছিলেন | History Honours | Calcutta University

জন লক কিভাবে উদারনৈতিক রাষ্ট্রের রূপরেখা তৈরি করেছিলেন | History Honours | Calcutta University 


ব্রিটিশ চিন্তাবিদ জন লক হলেন আধুনিক উদারনৈতিক রাষ্ট্রচিন্তার অগ্রদূত এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর প্রথম তাত্ত্বিক চিন্তাবিদ। তিনি ১৬৮৮ খ্রি: সংঘটিত ইংল্যান্ডের গৌরবময় বিপ্লবের সমর্থক ছিলেন। এই বিপ্লবের পটভূমিতে তিনি ইংল্যান্ড তথা ইউরোপের রাষ্ট্রচিন্তার জগৎকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। ম্যাকিয়েভেলির ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাধারা জন লকের রচনায় প্রতিফলিত হয়েছিল। সম্ভবত বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়গুলির প্রতি আগ্রহই তার রচনায় ধর্মনিরপেক্ষতার বাতাবরণ রচনা করেছিল।


১৬৩২ খ্রি: ইংল্যান্ডের এক গোঁড়া পিউরিটান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন জন লক। শিক্ষকতা থেকে চাকরি, গৃহশিক্ষক থেকে চিকিৎসাবিদ ইত্যাদি বিভিন্ন পেশার মধ্যে দিয়ে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। জন লকের রাষ্ট্রদর্শনের সম্পূর্ন পরিচয় পাওয়া যায় "Two Treatises of Government" গ্রন্থে। এছাড়াও তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেন। যার মধ্যে অন্যতম ছিল "Second Treatises", "Eassy Concerning Human Understanding" ইত্যাদি। 


এই সমস্ত গ্রন্থ থেকে জন লকের রাষ্ট্রচিন্তার প্রতিপাদ্য বিষয়গুলি জানা যায়। লকের মতে, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বে মানুষ প্রাকরাজনৈতিক অবস্থায় বাস করত। এই অবস্থায় মানুষের জীবন ছিল সহজ, সরল ও স্বাভাবিক। তখন সমাজে সাম্য ছিল এবং সকলেই ছিল স্বাধীন। পরবর্তীকালে সম্পত্তির অধিকারকে কেন্দ্র করে মানবসমাজে অসাম্য, জটিলতা ও সমস্যা বৃদ্ধি পায়। এই সমস্যার সমাধানে মানুষ সামাজিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল বলে লক প্রচার করেন।


জন লকের রাষ্ট্রচিন্তার ভিত্তি ও তার সামগ্রিক পরিচয় পাওয়া যায় "Eassy Concerning Human Understanding" নামক রচনায়। এই গ্রন্থে তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন, রাষ্ট্র মানবিক প্রচেষ্টা-নিরপেক্ষ, ঐশ্বরিক ইচ্ছার দ্বারা মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া একটা প্রতিষ্ঠান নয়। তাঁর বিখ্যাততর রচনা 'Two Treatises'- এ তিনি রাষ্ট্র ও সরকারের পারস্পরিক সম্পর্ক, অধিকার, মানুষের পার্থিব সম্পদ ও অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এছাড়া তিনি আরও জানান যে, রাজার ক্ষমতার উপর সাংবিধানিক নিয়ন্ত্রণ থাকা অত্যাবশ্যক।


রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পর্কে লক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি। তবে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ন নীরবতা অবলম্বন করেছেন এমন নয়। চুক্তির মাধ্যমে শাসন সংগঠন গড়ে তোলার যে তত্ত্ব লক তুলে ধরেছেন, তাতে এক ধরনের সংসদীয় শাসনতন্ত্রের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। চুক্তির মাধ্যমে যাদের হাতে রাষ্ট্রের চূড়ান্ত কর্তৃত্ব সমর্পিত হয় তারাই রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকারী। লকের মতে, মানুষের কল্যাণসাধনের শর্তেই শাসকগোষ্ঠীর হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা প্রদান করা হয়। শাসক অযোগ্য হলে তাকে সরিয়ে দেওয়ার অধিকার জনগণের আছে।


লকের রাষ্ট্রীয় ভাবনার "ধ্রুপপদ সম্মতি" রাজা বা যেকোনো শাসকের কর্তৃত্ব শাসিতের সম্মতির উপর নির্ভরশীল। দিব্যাধিকারের তত্ত্ব বরবাদ করে দিয়ে তিনি রাজনৈতিক দায়দায়ীত্বের একটা বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। সরকারের সৃষ্টির মূল কারণ হিসেবে তিনি জানিয়েছিলেন যে, এমন একটা সময় ছিল যখন পৃথিবীতে কোথাও কোনো সরকারের অস্তিত্ব ছিল না, সর্বত্র বিরাজমান ছিল নৈরাজ্য ও নিরাপত্তাহীনতা। 


লক একেই বলেছেন, 'A State of Nature'- যার দুঃসহতা প্রমাণিত হতে দেরি হয়নি। লক-কল্পিত প্রকৃতির রাজ্যের মানুষ স্বেচ্ছায় নিজেদের সহজাত অধিকার সার্বভৌম শক্তির হাতে তুলে দিয়েছিল বাস্তব কিছু কারণে। 


ব্যক্তির সম্পত্তি ভোগদখলের শর্ত হিসেবে জন লক ব্যক্তির শ্রমশক্তিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। শ্রমের উৎস হিসেবে তিনি ব্যক্তির ক্ষমতা ও বাহুবলকে নির্দেশ করেছেন। জনগণের সম্পত্তির ভিত্তিতে তিনি রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনার কথা বলেছেন। যে রাষ্ট্র বা সরকার অবিচার, শোষণ ও নির্যাতনের প্রতীক হিসেবে কাজ করে তার বিরোধিতা করা জনগণের স্বাভাবিক অধিকার বলে লক মনে করেন। তিনি এরূপ সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি বিপ্লব বা বিদ্রোহের কথা না বললেও রাষ্ট্রব্যবস্থার সর্বোচ্চ ক্ষমতা জনগণের হাতেই থাকতে উল্লেখ করেছেন।


রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে জন লকের বক্তব্য অতি উল্লেখযোগ্য হলেও এর বেশকিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। অনেকে মনে করেন, লকের রাষ্ট্রতত্ত্ব পুঁজিবাদকে প্রশ্রয় দিয়েছে। কেউ আবার মনে করেন, লক সম্পত্তির অধিকারকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এইসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও লকই ছিলেন উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম পথিকৃৎ। লক ব্যক্তি ও রাষ্ট্রকে আইনের শাসনের অধীনে আনার যে চিন্তা করেছিলেন তা আধুনিক বুর্জোয়া রাষ্ট্রে উদারনৈতিক রাষ্ট্রের রূপরেখা তৈরি করেছিল- একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।


তথ্য সূত্র:

১. ইউরোপে যুগান্তর-

ভাস্কর চক্রবর্তী | সুভাষরঞ্জন বসু | কিংশুক চট্টোপাধ্যায়।


২. আধুনিক ইউরোপ আদি পর্বের রূপান্তর- সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়।


৩. উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস সহায়িকা | প্রান্তিক | শ্রী দেবাশিষ মৌলিক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

World News

نموذج الاتصال

×