রক্ষণশীল উলেমাদের সাথে আকবরের বিরোধের কারণগুলি আলোচনা করো | History Honours Suggestion | Calcutta University

রক্ষণশীল উলেমাদের সাথে আকবরের বিরোধের কারণগুলি আলোচনা করো | History Honours Suggestion

রক্ষণশীল উলেমাদের সাথে আকবরের বিরোধের কারণগুলি আলোচনা করো | History Honours Suggestion | Calcutta University


সাধারণত ইসলামী শাস্ত্রে পারদর্শী পন্ডিত ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের উলেমা বলা হতো। মধ্যযুগের ভারতবর্ষের ইতিহাসে উলেমা শ্রেণীর প্রভাব ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ন। উলেমারা ছিলেন সরকারি ধর্ম বিশেষজ্ঞ। রাষ্ট্রের আইন ও নীতির ব্যাপারে উলেমারা গুরুত্বপূর্ন মতামত প্রদান করতেন। মুসলিম সমাজের কাছে উলেমাদের প্রতিপত্তি ছিল অসামান্য। 

এরা জনসাধারণের কাছে নিজেদের ভাবমূর্তি এমনভাবে উপস্থাপিত করতেন যাতে, অধিকাংশ মুসলিম এদের বিরুদ্ধাচরণে সহজে যেতেন না। ভারতে মুঘল শাসন শুরু হলেও উলেমারা রাষ্ট্র পরিচালনায় সম্রাটকে বিশেষ পরামর্শ দিতে থাকেন। সামাজিক শ্রেণী হিসেবে উলেমারা মুঘল যুগে নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য যথেষ্ট সক্রিয় ছিলেন।


সমগ্র বিশ্ব ইতিহাসে আকবর ছিলেন বিশ্বজনীন সহনশীলতার এক মূর্ত প্রতীক। ভারতবর্ষের নরপতিদের মধ্যে মহামতি আকবর ছিলেন ধর্ম সম্পর্কে যথেষ্ট উদার। স্বাভাবিকভাবেই উদার মনোভাব প্রদর্শন ও শাসব্যবস্থা থেকে ধর্মকে বিচ্যুত করার ফলে আকবরের সঙ্গে উলেমাদের সম্পর্ক ভালো ছিল না। 

আকবর কখনোই ধর্মীয় গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় দেননি। সকল ধর্মকে তিনি সমান চোখে দেখতেন। কিন্তু, ইসলাম ধর্মীয় প্রবক্তাদের মধ্যে অবিরত দ্বন্দ্বে আকবর ব্যথিত হন এবং উলেমাদের ধর্মান্ধতায় বিরক্ত হয়ে তিনি তাদের প্রতিপত্তি বিনষ্ট করতে আগ্রহী হন। যার ফলস্বরূপ, আকবরের সাথে উলেমাদের এক বিরোধের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।


সকল ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে আকবর ১৫৭৫ খ্রি: ইবাদতখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ভিনসেন্ট স্মিথের মতে, এই ইবাদতখানা ছিল "First World Religious Parliament"। আকবরের উপলব্ধি করেছিলেন যে, সমস্ত প্রকার ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সর্বধর্মসমন্বয় ও সমস্ত ধর্মের শান্তিপূর্ন সহাবস্থান কঠিন হলেও তা অত্যন্ত জরুরি।  

আকবর বুঝেছিলেন প্রত্যেক ধর্মের মধ্যেই কিছু সত্য নিহিত আছে। প্রত্যেক মানুষই একজন সর্বশক্তিমান ঈশ্বরে বিশ্বাসী। এইসময়ে আকবর ব্যক্তিগত ধর্ম বিশ্বাসের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। আর এই কারণে তার ব্যক্তিগত আচরণকে উলেমারা "ইসলাম বিরোধী" বলে অভিহিত করেন।

১৫৭৯ খ্রি: আকবর ' মাহজারনামা' ঘোষণা করে কোরআনের চূড়ান্ত ব্যাখ্যাকারী ক্ষমতা নিজের হাতে গ্রহণ করলে তা, উলেমাদের প্রচণ্ড ক্ষুদ্ধ করে তোলে। সম্রাটের এই সিদ্ধান্ত তাদের কাছে অস্তিত্বের সংকট হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ মুসলমানদের সমাজজীবন ছিল ধর্মভিত্তিক। শরিয়তি আইন অনুযায়ী সামাজিক বিধি ব্যবস্থা গৃহীত হতো। 

কোরআনের এই আইনবিধির ব্যাখ্যাকার ছিলেন উলেমাগণ, যাদের উপাধি ছিল 'মুজতাহিদ'। আকবর মাহজার ঘোষণার দ্বারা নিজেকে 'মুজতাহিদ' দের উপরে স্থাপন করে উলেমাদের পেশা ও অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছেন- এই অভিযোগ গোঁড়াপন্থীদের মুখর করে তোলে।


আকবর অনুসৃত মাহজার তার 'সুলহ-ই-কুল' বা। সর্বধর্মসমন্বয় সমস্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তির আদর্শ তুলে ধরেছিল। তবে 'মাহজারনামা' ঘোষণাপত্রের কারণে আকবরের সাথে উলেমাদের সম্পর্কের তিক্ততা আরও গভীর হয়েছিল। ষোড়শ শতকে সব মুসলমান শাসক যখন একমাত্র সত্য হিসেবে ইসলামকে তুলে ধরতে ব্যস্ত, তখন আকবর বিভিন্ন ধর্মের সার সংগ্রহে ব্যাপৃত থেকে গোঁড়া উলেমাদের ক্ষুদ্ধ করে তুলে ধরেছিলেন। 

তাই আকবরকে ধর্মচ্যুত বা ধর্মদ্রোহী প্রমাণিত করে উলেমারা তথাকথিত প্রবিত্র কর্তব্য সম্পাদনে উন্মুখ হয়েছিলেন। বস্তুত আকবর মুঘল সাম্রাজ্যকে একটি নিরেপেক্ষ শক্তি হিসেবে দাঁড় করতে চেয়েছিলেন , যা ক্ষমতাবাদী ও কতৃত্ববাদী উলেমাদের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।



উলেমারা ইসলামের ব্যবস্থা অনুযায়ী প্রতিপালিত হত। মুঘল আমলে তারা এক ধরনের নিষ্কর ভূমি পেতেন ভরণপোষণের জন্য। কে বলা হতো 'মাদাদ-ই-মাস'। ১৫৯৮ খ্রিঃ এক নির্দেশে বলা হয় যে নিষ্কর ভূখণ্ডের অর্ধেক ভাগ হবে কৃষিযোগ্য ভূমি এবং বাকি অর্ধেক হবে কর্ষিত ভূমি। আকবর উপলব্ধি করেছিলেন , বিপুল পরিমাণে 'মাদাদ-ই-মাস' ভূমি লাভের কারণে উলেমারা অলস ও উৎপাদন বিমুখ হয়ে উঠেছে। 

সেই কারণে তিনি উলেমা শ্রেণীকে কৃষির উন্নয়নে পরিশ্রম করতে বাধ্য করেছিলেন। তবে উলেমারা নিজেদের "ইসলামের সেবক' হিসেবে মনে করতেন। সম্রাটের এই কঠোর নির্দেশ উলেমাদের সঙ্গে আকবরের এক বিরোধের ছায়া তৈরি করে।


বস্তুত, তৎকালীন ভারতবর্ষে প্রচলিত সংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও অসংখ্য ধর্মবিশ্বাসকে আকবর একটি সংঘবদ্ধ শাসক শ্রেণীর নিরাপদ আশ্রয় আনতে চেয়েছিলেন। ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য প্রজা সাধারনের সার্বিক ঐক্য ও ভ্রাতৃসুলভ সহাবস্থানের আবশ্যিকতা বিষয়ে তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। ঐতিহাসিক রিজভী বলেছেন, উলেমা ও সুফিদের বিরুদ্ধে আকবর কঠোর হয়েছিলেন শাসনতান্ত্রিক প্রয়োজনে। গোঁড়া মুসলমান ও ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করা আকবরের উদ্দেশ্য ছিল না। 

এজন্য তিনি ধর্মকে রাজনীতির পরিপূরক হিসেবে গড়ে তুলতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। এই কারণে আকবর গোঁড়া উলেমাদের যাবতীয় প্রভাব রদ করার ব্যবস্থা করেছিলেন। যা নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধের সম্পর্ক তৈরি হয়। তবে উলেমাদের অতিরিক্ত ক্ষমতা খর্ব করে আকবর প্রশাসন ব্যবস্থাকে ধর্মনিরপেক্ষ করে তুলেছিলেন- এই বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।


১. মুঘল-রাজ থেকে কোম্পানি রাজ- অধ্যাপক গোপালকৃষ্ণ পাহাড়ী।

২. মুঘল যুগ থেকে কোম্পানি আমল- সৌমিত্র শ্রীমানী। 

৩. ভারতের ইতিহাস- মুঘল যুগ থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণ- তেসলিম চৌধুরী।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال

×