"খালিসা", "জায়গীর" ও "পাইবাকি" শব্দের অর্থ কি | CU History Honours 4th Semester
ভূমিকা:
সুপ্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বসবাসের মূল কেন্দ্র হলো গ্রাম। এই গ্রামের প্রায় অধিকাংশ মানুষ ছিল কৃষক এবং তাদের অর্থ উপার্জন ও জীবনযাপনের মূল ভিত্তি ছিল ভূমি।
এই ভূমি থেকে উৎপন্ন ফসলের একটি নির্দিষ্ট অংশ রাজস্ব হিসেবে আদায়ের রীতি সুলতানি আমল থেকেই প্রচলিত ছিল। মুঘল যুগেও এই রীতি প্রচলিত ছিল এবং জমিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে তা বন্টনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যথা-
১. খালিসা, ২. জায়গীর, ৩. পাইবাকি।
আবুল ফজল রচিত "আকবরনামা", শাহনওয়াজ খাঁ- রচিত "মাসির-উল-উমরা" প্রভৃতি সমকালীন বিবরণ এবং পেলসার্ট, মোরল্যান্ড, ইরফান হাবিব প্রমুখের বিশ্লেষণ থেকে মুঘল যুগের ভূমিরাজস্বের ভিত্তি ও বন্টন ব্যবস্থার নানা তথ্য পাওয়া যায়।
খালিসা:
খালিসা কথার অর্থ হল- 'সরকারের খাস জমি'। দেশের বিভিন্ন মহল ও পরগণাগুলিতে 'খলিসা' নামে চিহ্নিত জমিগুলি থেকে রাজস্ববাবদ আদায়কৃত অর্থ ছিল রাজস্ব ব্যবস্থার ভিত্তি। এই জমিগুলি ছিল খুবই উর্বর এবং এটি থেকে আদায়কৃত অর্থ স্থানীয় রাজকোষে জমা পড়ত।
স্থানীয় প্রশাসন পরিচালনা খাতে ব্যয় বাদ দিয়ে অতিরিক্ত অর্থ সুবার কোষাগারে জমা পড়ত এবং মোট রাজস্বের উদ্বৃত্ত অংশ কেন্দ্রীয় কোষাগারে জমা পড়ত। এই খালিসা জমির রাজস্ব সংক্রান্ত কাগজপত্র "দেওয়ান-ই-খালিসা" নামক দপ্তর প্রস্তুত করে সম্রাটের কাছে প্রেরণ করত।
জায়গীর:
জায়গীর শব্দের অর্থ হলো- দখল বা কোনো স্থানে অবস্থান। মুঘল যুগে সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ভূখণ্ডের জমি থেকে প্রাপ্ত সকল রাজস্বের একমাত্র দাবীদার ছিলেন সম্রাট। এই বিপুল রাজস্বের ভাগ বাঁটোয়ারা ছিল তার ইচ্ছাধীন।
এই রাজস্বের উৎস হিসাবে একটি নির্দিষ্ট বিরাট অংশ তিনি উচ্চ কর্মচারী বা মনোনীত ব্যক্তিদের বন্টন করে দিতেন। যে সকল অঞ্চল এমন শর্তাধীনে বন্টন করা হতো, তাদের বলা হতো জায়গীর বা তুয়ুল এবং এর প্রাপককে বলা হত জায়গীরদার বা তুয়ুলদার।
পাইবাকি:
'পাইবাকি' কথার অর্থ হলো- বন্টনযোগ্য জমি। অর্থাৎ বলা যায়, যে জমি জায়গীর হিসাবে বন্টনের জন্য নির্দিষ্ট অবস্থায় ছিল তাকে বলা হতো 'পাইবাকি'। পাইবাকি জমি অভিজাতদের বন্টন হওয়ার আগে পর্যন্ত রাজকর্মচারীরা দেখাশোনা করতেন।
পরবর্তীকালে এই জমি অভিজাতদের কাছে বন্টিত হলেও তা জায়গীরে রূপান্তরিত হতো। তবে এই ধরনের জমি মুঘল শাসনের প্রথম দিকে রাখা সম্ভব হয়েছিল, পরবর্তীকালে জায়গীর সংকট বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে এই ব্যবস্থা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।
সুতরাং মুঘল সম্রাটগণ সাম্রাজ্যের জমিগুলিকে বিভিন্ন ভাগে বন্টন করে রাজস্ব আদায়ের যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন তার ফলে মুঘল অর্থনীতি যথেষ্ট শক্তিশালী হয়েছিল। যার ফলস্বরূপ এর উপর ভিত্তি করেই মুঘল সাম্রাজ্য তৎকালীন বিশ্বে এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্থনৈতিক শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
তথ্য সূত্র:
মুঘল-রাজ থেকে কোম্পানি রাজ - অধ্যাপক গোপালকৃষ্ণ পাহাড়ী।