কর্ণাটকের দ্বিতীয় যুদ্ধ (১৭৪৯-৫৪ খ্রিঃ) | Second Battle of Karnataka

কর্ণাটকের দ্বিতীয় যুদ্ধ

কর্ণাটকের দ্বিতীয় যুদ্ধ (১৭৪৯-৫৪ খ্রিঃ) | Second Battle of Karnataka


ভারতের রাজনৈতিক দুর্বলতার সুযোগে দুপ্লে ভারতে একটি সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আনোয়ারউদ্দিনের শোচনীয় পরাজয় তাঁকে আরও উৎসাহিত করে। আই-লা-স্যাপেলের সন্ধির শর্ত অনুসারে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি ইংরেজদের মাদ্রাজ প্রত্যর্পণে বাধ্য হন। তিনি নতুন করে যুদ্ধের সুযোগ খুঁজছিলেন। বলা বাহুল্য, তাঁর সুযোগ আসতে দেরী হল না। ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে হায়দ্রাবাদের নবাব নিজাম-উল-মুলকের মৃত্যু হলে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র নাসির জঙ্গ ও দৌহিত্র মুজাফ্ফর জঙ্গ-এর মধ্যে সিংহাসন নিয়ে বিবাদ শুরু হয়। অপরদিকে কর্ণাটকের সিংহাসন নিয়েও তখন আনোয়ারউদ্দিন ও চাঁদা সাহেবের মধ্যে বিবাদ চলছে।


দাক্ষিণাত্যের এই রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে অংশগ্রহণ করে দুপ্লে তাঁর রাজনৈতিক বাসনা চরিতার্থ করতে সচেষ্ট হন। এই উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি কর্ণাটকের সিংহাসনে চাঁদা সাহেব এবং হায়দ্রাবাদের সিংহাসনে মুজাফ্ফর জঙ্গকে সমর্থন জানান। অতঃপর চাঁদা সাহেব, মুজাফ্ফর জঙ্গ ও ফরাসী বাহিনী একত্রে আনোয়ার উদ্দিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। 

ভেলোরের কাছে অম্বুরের যুদ্ধ (১৭৪৯ খ্রিঃ)-এ আনোয়ারউদ্দিন নিহত হন এবং তাঁর পুত্র মহম্মদ আলি ত্রিচিনোপল্লীতে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হন। চাঁদা সাহে ব কর্ণাটকের সিংহাসনে বসেন এবং এর ফলে কর্ণাটকে ফরাসী শক্তি অপ্রতিহত হয়ে ওঠে। কর্ণাটকে তারা নানা বাণিজ্যিক সুবিধা অর্জন করে এবং পণ্ডিচেরী সংলগ্ন ৮০টি গ্রাম তাদের হাতে যায়।


ফরাসী শক্তিবৃদ্ধিতে ইংরেজদের মনে ভীতির সঞ্চার হয়। এমতাবস্থায় তারা নাসির জঙ্গ ও মহম্মদ আলির পক্ষ সমর্থন করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ইংরেজ সাহায্যপুষ্ট নাসির জঙ্গের কাছে চাঁদা সাহেব পরাজিত হন এবং পণ্ডিচেরীতে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হন। অপরদিকে মুজাফ্ফর জঙ্গও নাসির জঙ্গের হাতে বন্দী হন। ইতিমধ্যে দুপ্লের নির্দেশে নাসির জঙ্গ আততায়ীর হস্তে নিহত হলে ১৬ই নভেম্বর, ১৭৫০ খ্রিঃ) মুজাফ্ফর জঙ্গ মুক্তিলাভ করেন। 


দুপ্লেbতাঁকে হায়দ্রাবাদের সিংহাসনে এবং চাঁদা সাহেবকে কর্ণাটকের নবাব পদে প্রতিষ্ঠিত করেন। কর্ণাটক ও হায়দ্রাবাদে নিজ প্রার্থী প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় দাক্ষিণাত্যে দুপ্লে তথা ফরাসী প্রাধান্য বিস্তৃত হয় এবং দুপ্নের ব্যক্তিগত মর্যাদা ও প্রতিপত্তি বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। ফরাসী কোম্পানী নানাভাবে পুরস্কৃত হয় এবং মুজাফ্ফর জঙ্গ দুপ্লেকে দাক্ষিণাত্যের কৃষ্ণা নদী থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত রাজ্যাংশের ‘গভর্নর' হিসেবে স্বীকৃতি দেন। 


মুসলিপত্তম-সহ পণ্ডিচেরী থেকে উড়িষ্যার উপকূলবর্তী অঞ্চল ফরাসীদের অর্পণ করা হয়। দুপ্লে ব্যক্তিগতভাবে বার্ষিক দশ হাজার পাউন্ড আয়ের একটি জায়গীর ও প্রভূত অর্থ লাভ করেন। ইতিমধ্যে মুজাফ্ফর জঙ্গ নিহত হলে (১৭৫১ খ্রিঃ) নিজাম-উল-লকের তৃতীয় পুত্র সলাবৎ জঙ্গ-কে হায়দ্রাবাদের সিংহাসনে বসান হয়। 

নবাবের নিরাপত্তার তাগিদে ফরাসী সেনাপতি বুসী-র নেতৃত্বে হায়দ্রাবাদে একটি বিশাল ফরাসী সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয় – যদিও এর প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল নিজামের দরবারে ফরাসী প্রাধান্য অপ্রতিহত রাখা। প্রকৃতপক্ষে, এই সময় ফরাসী কোম্পানীর শক্তি তুঙ্গে পৌঁছেছিল। দুপ্লে তাঁর কল্পনারও অতীত সাফল্য অর্জন করেছিলেন। ফরাসীরা ভারতীয় নৃপতিদের সংগে মিত্রতা স্থাপন করে কিছু স্বার্থসিদ্ধি করতে চেয়েছিল মাত্র, কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল যে, ভারতীয় শক্তিগুলি তাদের আজ্ঞাধীন দাসে পরিণত হয়েছে।


আনোয়ারউদ্দিনের পুত্র মহম্মদ আলি তখনও ত্রিচিনোপল্লীতে অবস্থান করছিলেন। সামরিক ও বাণিজ্যের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই স্থানটি দখলের জন্য ফরাসী বাহিনী অগ্রসর হলে মাদ্রাজের ইংরেজ শাসনকর্তা সান্ডার্স মহম্মদ আলির পক্ষ অবলম্বন করেন। কেবলমাত্র ইংরেজ পক্ষই নয়—মহীশূর, তাঞ্জোর ও গুটির মারাঠাশাসকও মহম্মদ আলির সাহায্যে অগ্রসর হন। দাক্ষিণাত্যে ইংরেজদের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে রবার্ট ক্লাইভ-এর আবির্ভাব হয়। দাক্ষিণাত্যে ফরাসীদের যখন জয়-জয়কার। 

ত্রিচিনো পল্লীতে যখন ফরাসীদের অবরোধ চলছে ঠিক তখনই তরুণ করণিক রবার্ট ক্লাইভ মসী ছেড়ে অসি ধরেন এবং কর্ণাটকের রাজধানী আর্কট আক্রমণের প্রস্তাব দেন। এর ফলে আর্কট রক্ষার জন্য ফরাসী বাহিনী ত্রিচিনোপল্লী থেকে সরে খ্রিস্টাব্দে তিনি দুপ্লের নীতি পরিবর্তন করে ইংরেজদের সংগে এক সন্ধি


আসবে এবং তাতে ত্রিচিনোপল্লীর ওপর থেকে চাপ কমবে। মাত্র দুইশ’ ইংরেজ ও তিনশ' দেশীয় সৈনিক নিয়ে ক্লাইভ বিদ্যুৎ-গতিতে অরক্ষিত রাজধানী আর্কট দখল করে নেন। এর ফলে যুদ্ধের গতি পরিবর্তিত হয় এবং ফরাসীদের ক্রমাগত পরাজয় ঘটতে থাকে। এদিকে ত্রিচিনোপল্লী থেকে সেনা সরে যাওয়ায় ফরাসীরা সেখানে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং এর ফলে ইংরেজ বাহিনী দুপ্লে ও চাঁদা সাহেবের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করে ত্রিচিনোপল্লী অবরোধ মুক্ত করেন, বন্দী চাঁদা সাহেবকে হত্যা করা হয় এবং মহম্মদ আলি কর্ণাটকের সিংহাসনে বসেন (১৭৫২ খ্রিঃ)। 


এর ফলে কর্ণাটকে ফরাসী প্রভাব অবলুপ্ত হয় এবং ইংরেজ প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইঙ্গ-ফরাসী যুদ্ধের ইতিহাসে ইংরেজদের আর্কট দখল এক অতি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই যুদ্ধ সামরিক শক্তি হিসেবে ইংরেজদের সুনাম বৃদ্ধি করে এবং ফরাসী মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়। এর পরেও দুপ্লে আরও দু'বছর ধরে যুদ্ধ করে কোন সুবিধা করতে পারেন নি। 

১৭৫৪ খ্রিস্টাব্দে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তিনি পদচ্যুত হয়ে ফ্রান্সে ফিরে যান এবং গোদেচ্ছ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ১৭৫৫ স্বাক্ষর করেন। সন্ধির শর্ত অনুসারে ইংরেজ ও ফরাসী একে অন্যের অধিকৃত স্থানগুলি ফেরৎ দেয় এবং স্থির হয় যে, ভবিষ্যতে দেশীয় রাজন্যবর্গের বিবাদে কোন পক্ষ হস্তক্ষেপ করবে না।


তথ্য সূত্র:

স্বদেশ পরিচয়-জীবন মুখোপাধ্যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

World News

نموذج الاتصال

×