কর্ণাটকের প্রথম যুদ্ধ (১৭৪৬-৪৮) | First Battle of Karnataka

কর্ণাটকের প্রথম যুদ্ধ (১৭৪৬-৪৮)

 

কর্ণাটকের প্রথম যুদ্ধ (১৭৪৬-৪৮) | First Battle of Karnataka


ভারতে বাণিজ্যিক প্রাধান্য লাভের দ্বন্দ্বে ইংরেজ ও ফরাসীরা পরস্পর-বিরোধী দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এই দুই বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বী দক্ষিণ ভারতে রাজনৈতিক প্রাধান্য লাভের জন্য সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। এই যুদ্ধ করমণ্ডল উপকূলে সংঘটিত হয়। ইওরোপীয়রা করমণ্ডল উপকূলের নামকরণ করে কর্ণাট বা কৰ্ণাটক। এই কারণে এই যুদ্ধকে কর্ণাটকের যুদ্ধ বলা হয়।


কর্ণাটকের প্রথম যুদ্ধ (১৭৪৬-৪৮):


মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারীদের দুর্বলতার সুযোগে অন্যান্য রাজ্যের মত দাক্ষিণাত্যের হায়দ্রাবাদ ও কর্ণাটক রাজ্য স্বাধীন হয়ে পড়ে। আইনত কর্ণাটক ছিল হায়দ্রাবাদের নিজামের অধীনে, কিন্তু কর্ণাটকের নবাব দোস্ত আলি কার্যত স্বাধীনভাবেই রাজ্য চালাতেন। ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে মারাঠাদের সংগে সংঘর্ষে কর্ণাটকের নবাব দোস্ত আলির মৃত্যু ঘটলে কর্ণাটকের সিংহাসন নিয়ে এক গোলযোগ দেখা দেয়। 

নিজামের মনোনীত ব্যক্তি আনোয়ারউদ্দিন কর্ণাটকের সিংহাসনে বসেন। দোস্ত আলির জামাতা চাঁদা সাহেব সিংহাসনের অন্যতম দাবীদার ছিলেন। তিনি বা তাঁর অনুগামীদের পক্ষে আনোয়ারউদ্দিনকে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না।


১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে ইওরোপে অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার সংক্রান্ত যুদ্ধ শুরু হলে আমেরিকা ও ভারতে বাণিজ্য ক্ষেত্রে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ইংরেজ ও ফরাসীদের মধ্যেও যুদ্ধ শুরু হয়। ফরাসী প্রতিনিধি দুপ্লে ভারতে এ ধরনের কোন সংঘর্ষের বিরোধী ছিলেন এবং এ সম্পর্কে তিনি ইংরেজদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছিলেন। 

এমতাবস্তায় ইংরেজ পর সেনাপতি কমডোর বার্নেট ১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দে কয়েকটি ফরাসী যুদ্ধজাহাজ দখল করে নিলে ভারতে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। ভারতে ফরাসীদের শক্তিশালী নৌ-বহর না থাকায় পণ্ডিচেরীর ফরাসী শাসনকর্তা দুপ্নে মরিশাসের ফরাসী গভর্নর লা-বুর্দন-এর কাছে কয়েকটি যুদ্ধ জাহাজ পাঠাবার আবেদন জানান। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি আট-টি যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে ভারত


মহাসাগরে এসে উপস্থিত হন। ফরাসী নৌ-বহরের শক্তিতে আতঙ্কিত হয়ে ইংরেজরা মাদ্রাজকে একরকম অরক্ষিত রেখেই মাদ্রাজ উপকূল ত্যাগ করে পূর্ব উপকূলে হুগলীতে আশ্রয় গ্রহণ করল। ফলে ১৭৪৬ খ্রিস্টাব্দে পণ্ডিচেরীর ফরাসী শাসনকর্তা দুপ্লে অতি সহজেই ইংরেজ বাণিজ্যকেন্দ্র ও সামরিক-ঘাঁটি মাদ্রাজ দখল করেন। 

মাদ্রাজ ছিল কর্ণাটক রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত আনোয়ারউদ্দিনের শাসনাধীন অঞ্চল। বিপন্ন ইংরেজরা তাঁর শরণাপন্ন হলে তিনি দুপ্লেকে মাদ্রাজ থেকে সৈন্য অপসারণের নির্দেশ দেন। কূটকৌশলী দুপ্লে জানান যে, তাঁকে দান করার জন্যই ফরাসীরা মাদ্রাজ দখল করেছে। দুপ্লে তাঁর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে আনোয়ারউদ্দিন ১০,০০০ সৈন্য নিয়ে ফরাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। 


মাইলাপুর বা সেন্ট থোমের যুদ্ধে (১৭৪৬ খ্রিঃ) ফরাসী বাহিনীর মাত্র ৯৩০ জন (২৩০ জন ইওরোপীয়) সৈন্যের কাছে নবাবের বিরাট বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। এই যুদ্ধ ছিল স্থলযুদ্ধে ইওরোপীয়দের কাছে ভারতীয়দের প্রথম পরাজয়। ফরাসীদের এই সামরিক সাফল্য অশ্বারোহী বাহিনীর ওপর গোলন্দাজ বাহিনী ও সুশিক্ষিত পদাতিক সৈন্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত করে। মুষ্টিমেয় ফরাসী সৈন্যের হাতে নবাবের বিরাট বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ইওরোপীয়দের চোখ খুলে দেয়। তারা বুঝতে পারে যে, চেষ্টা করলে অনায়াসেই তারা ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনে সক্ষম। 


ঐতিহাসিক ম্যালেসন বলেন যে, এই যুদ্ধের ফলে নিঃশব্দে কিন্তু সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হল যে, করমণ্ডল উপকূলে যুদ্ধরত দু'টি ইওরোপীয় শক্তির একটির দ্বারা ভারত বিজিত হবে। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা ভারতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণে উৎসাহিত হয়ে ওঠে।


ঐতিহাসিক ফিলিপস্ বলেন যে, এই যুদ্ধের ফলে ভারতে বিদেশী আধিপত্য স্থাপনের পথ উন্মুক্ত হয়ে যায় এবং এরপর ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশী বণিকদের হস্তক্ষেপ না করার আর কোন কারণ ছিল না।* ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে আই-লাস্যাপেল-এর সন্ধি দ্বারা ইওরোপে অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার সংক্রান্ত যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটলে ভারতেও ইংরেজ ও ফরাসীদের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হয়। সন্ধির শর্তানুসারে দুপ্লে একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাদ্রাজ ইংরেজদের ফিরিয়ে দেন। এইভাবে কর্ণাটকের প্রথম যুদ্ধের অবসান হল।  


তথ্য সূত্র:

স্বদেশ পরিচয়-জীবন মুখোপাধ্যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال

×