পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের ফলাফল বা গুরুত্ব | Results of Third Battle of Panipat
পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে সব ঐতিহাসিক একমত নন। ঐতিহাসিক এলফিন্স্টোন-এর মতে, এই যুদ্ধে মারাঠাদের বিপর্যয় ছিল সর্বাত্মক। ঐতিহাসিক পার্সিভ্যাল স্পিয়ার বলেন যে, পানিপথের যুদ্ধ মারাঠা জাতির পক্ষে কেবলমাত্র সামরিক পরাজয় ছিল না, মারাঠা জাতির স্বার্থের পক্ষে এই যুদ্ধ ছিল বিপর্যয়কর।
জি. এস. সারদেশাই, রাজওয়াদে প্রমুখ মারাঠী ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে, এই যুদ্ধকে মারাঠাদের ‘জাতীয় বিপর্যয়’ বলা যায় না, কারণ আহম্মদ শাহ আবদালী যুদ্ধে জয়লাভ করলেও দিল্লীর ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ স্থাপিত হয় নি, পরবর্তী পেশোয়া প্রথম মাধব রাও (১৭৬১৭২ খ্রিঃ)-এর নেতৃত্বে মারাঠাদের লুপ্ত গৌরব বহুলাংশে পুনরুদ্ধার হয় এবং এই সময় মারাঠা শক্তি উত্তর ভারতে আবার দুর্বার হয়ে ওঠে। তাঁ বলেন যে, এই যুদ্ধের কিছুকাল পরেই আবদালী মারাঠাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সন্ধি করতে বাধ্য হন, ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে মারাঠাদের সাহায্যেই মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম দিল্লীতে ক্ষমতায় বসেন এবং ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে মহাদাজী সিন্ধিয়া দিল্লী দখল করেন।
১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীতে ইংরেজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেই মারাঠা আধিপত্যের অবসান ঘটে। জি. এস. সারদেশাই-এর মতে পানিপথে প্রচুর লোকক্ষয় ব্যতীত মারাঠাদের বিশেষ ক্ষতি হয় নি। তাঁর মতে, পানিপথের মারাঠা বিপর্যয় লোকক্ষয়কারী প্রাকৃতিক বিপর্যয় অপেক্ষা বেশী কিছু নয়। ঐহিহাসিক গ্রান্ট ডাফ-এর মতে পানিপথের যুদ্ধ অপেক্ষা মাধব রাও-এর অকালমৃত্যু মারাঠাদের পক্ষে অধিকতর ক্ষতিকর ছিল।
ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার-এর মতে—“পানিপথের রণক্ষেত্রেই ভারতের ভাগ্য নির্ধারিত হয়।”
পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের ফলাফল
(১) মারাঠাদের সর্বভারতীয় হিন্দু সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন চিরতরে বিলুপ্ত হয়, পেশোয়ার শক্তি ও মর্যাদা যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস পায় এবং মারাঠা সামরিক শক্তির দুর্বলতাও সকলের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে মারাঠা শক্তির পুনরুত্থান দেখা দেয় ঠিকই, কিন্তু পূর্বের সেই দুর্দমনীয় গতিবেগ অপেক্ষা তা অনেক নিষ্প্রভ ছিল।
(২) মারাঠাদের পতনের ফলে ইংরেজরা বাংলাদেশ ও দাক্ষিণাত্যে আধিপত্য স্থাপনের সুযোগ পায়। মহীশূরে হায়দার আলি শক্তিশালী হয়ে ওঠেন এবং শিখদের উত্থান সহজতর হয়।
(৩) পানিপথের যুদ্ধের পরে পুনরুত্থিত মারাঠা শক্তির পক্ষে ইংরেজদের দমন করা সম্ভব হয় নি—আগামী দিনে ইংরেজ শক্তি ভারতের ভাগ্যনিয়ন্ত্রা হয়ে ওঠে। ডঃ জগদীশ নারায়ণ সরকার বলেন যে, পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ ভারত ইতিহাসের গতিকে যেভাবে প্রভাবিত করেছে তেমন আর কোন কিছু করে নি। এই যুদ্ধ মোগল ও মারাঠা শক্তিকে সর্বস্বান্ত করে ভারতে ব্রিটিশ আধিপত্যের পথ প্রশস্ত করে।
তথ্য সূত্র:
স্বদেশ পরিচয়-জীবন মুখোপাধ্যায়।