ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অবদান



 

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অবদান/ ভূমিকা | ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও আজাদ হিন্দ ফৌজ

ভূমিকা:

ভারতের জাতীয়তাবাদী মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এক অবিস্মরণীয় নাম। তাঁর ত্যাগ, তিতিক্ষা, দেশপ্রেম, বিপ্লব-নিষ্ঠা, অদম্য মনোবল, চারিত্রিক ` দৃঢ়তা ও দুর্জয় সাহস দেশবাসী আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। তৎকালীন বাংলার একটি ধনী ও অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের সকল প্রলোভন ত্যাগ করে দেশ ও জাতির সেবায় তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন অগ্রগণ্য বীরনায়ক ও দেশপ্রেমিক হিসেবে ইতিহাসে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। 


সংগ্রামের সূচনা:

নেতাজী সুভাষচন্দ্রের জীবন ছিল অবিরাম সাধনা ও সংগ্রামের জীবন। শ্রীরামকৃষ্ণবিবেকানন্দের ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ তরুণ সুভাষ কৈশোরের দিনগুলিতে নিজেকে সমাজসেবায় ব্যাপৃত রেখেছিলেন। দরিদ্রের সেবা, শবদাহ, কলেরা ও বসন্ত রোগীর সেবা এবং অন্যান্য সমাজসেবামূলক কাজই ছিল তাঁর প্রধান আকর্ষণ। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যার থেকে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। তরুণ দেশপ্রেমিক সুভাষচন্দ্রের জীবনে এ সময় এক ভয়ঙ্কর দুর্যোগ নেমে আসে। 


ভারতীয়দের সম্পর্কে অধ্যাপক ওটেনের একটি মন্তব্য ছাত্রদের মধ্যে প্রবল বিক্ষোভের সঞ্চার করে। ওটেন ছাত্রদের হাতে লাঞ্ছিত হন। ছাত্রনেতা হিসেবে সুভাষচন্দ্র কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন। বস্তুত তাঁর জীবনে স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু এখান থেকেই। শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের চেষ্টায় তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তির সুযোগ পান এবং ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে বিএ পরীক্ষায় দর্শন শালে দ্বিতীয় মান অধিকার করেন।



আই.সি.এস.- এর চাকরি ত্যাগ:


সে যুগে সমস্ত মেধাবী ও অভিজাত বংশীয় ছাত্রদের লক্ষ্য ছিল আই.সি.এস. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ সরকারি পদ লাভ করা। যুগের প্রথা অনুযায়ী পারিবারিক ইচ্ছানুসারে আই.সি.এস. পরীক্ষা দেবার উদ্দেশ্যে তিনি বিলেত যাত্রা করেন (১১ই সেপ্টেম্বর, ১৯১৯ খ্রিঃ)। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সেরা ছাত্রদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়ে তিনি আই.সি.এস. পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। এই লোভনীয় ‘স্বর্গজাত’ চাকরির সিংহ দরজার সামনে এসেও তিনি স্বেচ্ছায় সেই চাকরি ত্যাগ করে দেশমাতৃকার মুক্তিযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিশ্ব-ইতিহাসের পাতায় এ ধরনের নজির খুব অল্পই আছে। জীবনের শুরুতেই তিনি এক অসাধারণ ত্যাগের নজির তৈরি করলেন।


অসহযোগ আন্দোলন: 

১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই জুলাই তিনি বোম্বাইতে পৌঁছলেন। গান্ধীজীর ডাকে সারা ভারত জুড়ে তখন অসহযোগ আন্দোলন চলছে। সারা দেশ উত্তাল। সে দিনই তিনি ভারতের ‘জন-গণ-মন-অধিনায়ক’ গান্ধীজীর সঙ্গে দেখা করে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করার কথা জানালেন। গান্ধীজী তাঁকে বাংলার বিশিষ্ট জননায়ক ‘দেশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে দেখা করতে বললেন। দেশবন্ধু নবাগত সুভাষচন্দ্রের ওপর তিনটি গুরুদায়িত্ব অর্পণ করলেন। 

(১) অসহযোগ আন্দোলনকালে দেশের নানা স্থানে জাতীয় বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় স্থাপিত হয়। কলকাতায় যে জাতীয় কলেজ স্থাপিত হয় সুভাষচন্দ্রকে তার অধ্যক্ষ নিযুক্ত করা হয়। তাঁর সুষ্ঠু পরিচালনায় জাতীয় মহাবিদ্যালয় একটি সুন্দর ও সুষ্ঠু রূপ পরিগ্রহ করে। 

(২) তাঁকে বঙ্গীয় কংগ্রেস কমিটির প্রচার সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়। 

(৩) এছাড়া, কংগ্রেসের অধীনে একটি জাতীয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের দায়িত্বও তাঁর ওপর অর্পিত হয়। এই তিনটি কাজই তিনি সুচারুরূপে সম্পন্ন করেন। তাঁর নেতৃত্বে লাখ লাখ তরুণ নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক দল গড়ে ওঠে। সারা দেশে এক অদ্ভুত উন্মাদনা দেখা দেয়। তাঁর সংগঠন শক্তির পরিচয় পাওয়া যায় ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে ডিসেম্বর। সেদিন ইংল্যান্ডের যুবরাজের কলকাতায় আসার কথা ছিল। সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে সেদিন কলকাতায় পূর্ণ হরতাল পালিত হয়।



স্বরাজ্য দল:

অসহযোগ আন্দোলনের শোচনীয় ব্যর্থতার পর চিত্তরঞ্জন দাশ ও মতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে ‘স্বরাজ্য দল’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় দেশবন্ধু ছিলেন। বঙ্গীয় ‘স্বরাজ্য দল’-এর সভাপতি, বঙ্গীয় আইনসভার দলীয় নেতা এবং কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র। দেশবন্ধুর অনুগামী হিসেবে সুভাষচন্দ্রের ওপর নানা গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়। তাঁকে ‘স্বরাজ্য দল’-এর বাংলা দৈনিক ‘বাঙ্গলার কথা’ এবং ইংরেজি দৈনিক ‘ফরওয়ার্ড’ দেখতে হত। এ সময় তিনি বঙ্গীয় কংগ্রেসের সম্পাদক এবং কলকাতা কর্পোরেশনের প্রধান কর্মাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। সেদিন তাঁর কর্মদক্ষতা ও সংগঠন শক্তি সকলকে বিস্মিত করে।


যুব আন্দোলন:

সুভাষচন্দ্র নিজেকে কেবলমাত্র নিছক রাজনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি স্পষ্টই উপলব্ধি করেন যে, রাজনীতি ও দেশমাতৃকার বৃহত্তর স্বার্থে ছাত্র ও যুব সম্প্রদায়, শ্রমিক ও কৃষক সকলকে সংগঠিত করা দরকার। তাঁর নেতৃত্বে বাংলা ও ভারতের নানা স্থানে ছাত্র ও যুব আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তিনি স্পষ্টই উপলব্ধি করেন যে, ছাত্র ও যুবকেরাই যেকোন আন্দোলনের চালিকা শক্তি। এই উদ্দেশ্যে তিনি সারা ভারতের নানা স্থানে ভ্রমণ করে তাদের মনে নতুন চেতনা ও আদর্শের সঞ্চার করেন।


শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলন:

শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের সঙ্গেও তিনি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, দেশের শ্রমিক ও কৃষককে জাতীয় আন্দোলনে সামিল করতে না পারলে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সভাপতি নিযুক্ত হন। এছাড়াও তিনি বহু কারখানার শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি ছিলেন। কৃষক আন্দোলনের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ‘নিখিল ভারত কৃষক সভা’ গঠিত হলে তিনি তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন। সুভাষচন্দ্রের এই বিশ্বাস সুদৃঢ় ছিল যে, হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ব্যতীত ভারতের মুক্তি অর্জন সম্ভব নয়। তাঁর লক্ষ্য ছিল হিন্দু-মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মের সমন্বয়ে ঐক্যবদ্ধ ভারত। 


হিন্দু-মুসলিম ঐক্য:

ভারত ইতিহাসের বীর মুসলিম চরিত্র বাহাদুর শাহ, আকবর, সিরাজ সম্পর্কে তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সমকালীন মুসলিম জনতা ও নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল এবং তাঁর বহু বিশ্বস্ত অনুগামীই ছিলেন মুসলিম। আজাদ-হিন্দ-বাহিনীতে হিন্দু-মুসলিম বা অন্য কোন ধর্ম বা প্রাদেশিক কোন বিভেদ ছিল না। একটি ভাষণে তিনি বলেন, “আমরা ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন ভারত রচনার জন্য প্রাণপণ সংগ্রাম করছি। আমি পাকিস্তান প্রস্তাবের ভিত্তিতে আমাদের মাতৃভূমিকে বিভক্ত করার ঘোরতর বিরোধী—আমাদের দেবাত্মা মাতৃভূমিকে খণ্ড করা চলবে না।” 


বিপ্লবী দল:

বাংলা তথা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের বিপ্লবীদের সঙ্গেও তাঁর নিবিড় যোগাযোগ ছিল। বিপ্লবীদের ত্যাগ, তিতিক্ষা, আত্মোৎসর্গ তাঁকে অভিভূত করেছিল। বাংলার ‘যুগান্তর’ দলভুক্ত বিপ্লবীরা তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতেন। সুভাষচন্দ্রের আহ্বানে বহু বিপ্লবী কংগ্রেসে যোগ দেন এবং সুভাষচন্দ্রও তাঁদের কলকাতা কর্পোরেশনের বিভিন্ন বিভাগে চাকরি দেন। পরবর্তীকালেও ‘যুগান্তর' গোষ্ঠী সর্বদাই তাঁর সঙ্গে ছিল।


জাতীয় আন্দোলনের লক্ষ্য:

ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের লক্ষ্য কি—এ নিয়েও নেতৃত্বের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। গান্ধীজী প্রমুখ প্রবীণ নেতৃত্ব চাইতেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন বা ‘ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস'। অপরপক্ষে, সুভাষচন্দ্র ও জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বাধীন তরুণরা চাইতেন পূর্ণ স্বাধীনতা। এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের কলকাতা কংগ্রেসে তুমুল বিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে লাহোর কংগ্রেসে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতির ভাষণে তরুণ জওহরলাল বলেন যে, পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনই হল জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্য। এইভাবে গান্ধীজীর আপস নীতির স্থলে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্য হিসেবে ঘোষিত হয়।



কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্র:

কংগ্রেসের অভ্যন্তরে তখন বামপন্থী তরুণরা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এই বামপন্থীদের খুশি করার জন্য ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের হরিপুরা অধিবেশনে সুভাষচন্দ্রকে সভাপতি মনোনীত করা হয়। সভাপতি হিসেবে তাঁর কার্যকলাপ ও নানা প্রশ্নে গান্ধীজীর সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য প্রকট হয়ে ওঠে। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরী কংগ্রেস অধিবেশনের জন্য পুনরায় তাঁকে সভাপতি করার দাবি উঠলে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বিবাদ শুরু হয়। নতুন সভাপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় এবং সুভাষচন্দ্র তাতে জয়যুক্ত হন। নবনিযুক্ত সভাপতি যে কার্যনির্বাহক সমিতি গঠন করেন তার অসহযোগিতায় সুভাষচন্দ্র পদত্যাগে বাধ্য হন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, তাঁর বামপন্থা কংগ্রেস নেতৃত্বের পছন্দ নয়। তাই ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৩রা মে কংগ্রেসের অভ্যন্তরেই তিনি ‘ফরওয়ার্ড ব্লক' নামে একটি দল গঠন করেন এবং বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ করতে সচেষ্ট হন। ক্ষুব্ধ কংগ্রেস নেতৃত্ব তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করে।


সুভাষচন্দ্র বসুর ভারত ত্যাগ:

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি বৈদেশিক শক্তির সাহায্যে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পরিকল্পনা করেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ইংরেজ কোন দিনই ভারতবাসীকে স্বাধীনতা দান করবে না। ব্রিটিশ সরকারও সুভাষচন্দ্রের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সতর্ক ছিল। এই কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ভারত সরকার তার চরম শত্রু সুভাষচন্দ্র বসুকে ‘ভারতরক্ষা আইন’-এ গ্রেপ্তার করে (২রা জুলাই, ১৯৪০ খ্রিঃ)। কারাগারে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে কলকাতায় তাঁর নিজগৃহে সশস্ত্র পুলিশ প্রহরায় অন্তরীণ করে রাখা হয় (৫ই ডিসেম্বর, ১৯৪০ খ্রিঃ)। এই অবস্থায় সদা-সতর্ক পুলিশের দৃষ্টি এড়িয়ে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই জানুয়ারি তিনি কলকাতা ত্যাগ করেন এবং কাবুলের  মধ্য দিয়ে ভারত ত্যাগ করে আফগানিস্তান ও রাশিয়া হয়ে জার্মানীতে হাজির হন। তিনি জার্মানীতে হিটলার এবং ইতালীতে মুসোলিনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং এই দুই রাষ্ট্রনায়ক ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁকে সর্বতোভাবে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। জার্মান সরকারের পূর্ণ সহযোগিতায় ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে জার্মানীর হাতে বন্দী ৪০০ ভারতীয় সৈন্য নিয়ে তিনি এক সেনাদল গঠন করেন। জার্মানীতে বন্দী সেনাদল তাঁর দেশপ্রেম ও বিপ্লবী আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে তাঁকে ‘নেতাজী’ আখ্যায় ভূষিত করে। 



আজাদ হিন্দ বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ:

১৯৪৩খ্রিস্টাব্দের ১৩ই জুন দুঃসাহসে ভর করে সুভাষচন্দ্র জার্মানী থেকে জাপানের রাজধানী টোকিওতে হাজির হন। জাপানী পার্লামেন্ট ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতীয় মুক্তি সংগ্রামকে সর্বতোভাবে সাহায্যের নীতি ঘোষণা করে। সুভাষচন্দ্রের আগমনে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয়দের মনে প্রবল উদ্দীপনা দেখা দেয়। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা জুলাই সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত এক বিশাল সভায় রাসবিহারী বসু সুভাষচন্দ্রের হাতে ‘ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেডেন্স লীগ’-এর সব দায়িত্ব অর্পণ করেন। ২৫শে আগস্ট সুভাষচন্দ্র আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আজাদ-হিন্দ-বাহিনী’-র নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং সেনাবাহিনীর আমূল পুনর্গঠনের কাজে হাত দেন। দলে দলে হিন্দু-মুসলিম, নারী-পুরুষ ও বালক-বালিকা এই সেনাদলে যোগদান করতে থাকে।



আজাদ হিন্দ সরকার:

১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২১শে অক্টোবর নেতাজী সিঙ্গাপুরে ‘আজাদ-হিন্দ-সরকার’ বা স্বাধীন ভারত সরকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন। ২৩শে অক্টোবর আজাদ-হিন্দ-সরকার ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সামান্য কয়েক দিনের মধ্যেই জাপান, থাইল্যান্ড, জার্মানী, ইতালী প্রভৃতি পৃথিবীর নয়টি রাষ্ট্র এই সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। দলে দলে ভারতীয়রা আজাদ-হিন্দ-বাহিনীতে যোগদান করেন। নেতাজীর আহ্বানে প্রবাসী ভারতীয়রা মুক্তহস্তে যুদ্ধ তহবিলে দান করতে থাকেন। 



দিল্লি চলো অভিযান:

১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা জানুয়ারী নেতাজী রেঙ্গুনে আসেন এবং সেখানে তাঁর প্রধান সামরিক দপ্তর স্থাপিত হয়। অতঃপর শুরু হয়' আজাদ-হিন্দু-বাহিনীর ভারত অভিযান। সেনাদলের সামনে তিনি ধ্বনি দেন ‘দিল্লী চলো, কারণ দিল্লী ভারতের রাজধানী। জাপানী নেতৃবৃন্দের সহযোগিতা, নেতাজীর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও উজ্জীবনী মন্ত্রে দীক্ষিত আজাদ-হিন্দ-বাহিনী অমিত বিক্রমের সঙ্গে মণিপুরের রাজধানী ইম্ফল পর্যন্ত অগ্রসর হয়। শেষ পর্যন্ত তাদের সব উদ্যম ব্যর্থ হলেও বিশ্ব ইতিহাসে তারা এক অসাধারণ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে যায়। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট এটলী ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনার জন্য ভারতে একটি মন্ত্রী-মিশন পাঠাবার কথা ঘোষণা করেন। পরবর্তীকালে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে এটলী ভারতে এলে তাঁকে ঐ ঘোষণার কারণ জিজ্ঞাসা করা হয়। তিনি স্পষ্টই বলেন যে, ‘সুভাষচন্দ্র ও তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রভাব’-এ তিনি ঐ ঘোষণায় বাধ্য হন। 



মূল্যায়ন:

বিখ্যাত ব্রিটিশ লেখক মাইকেল এডওয়ার্ডস্ লিখছেন যে, “কংগ্রেসে বড় নেতাদের মধ্যে একমাত্র সুভাষচন্দ্র বসুই ছিলেন ক্ষত্রিয়।” গান্ধীজী-র কাছে তিনি ছিলেন, ‘দেশপ্রেমিকদের রাজাধিরাজ'। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ‘দেশনায়ক’ হিসেবে বরণ করেছিলেন। বস্তুত ভারতের বীর সন্তান নেতাজী সুভাষচন্দ্রের ত্যাগ, তিতিক্ষা, দেশপ্রেম ও অসমসাহসিকতা ভারত ইতিহাসে তাঁকে এক বিশিষ্ট স্থান দান করেছে। উপসংহার জীবনের সূচনাতেই ত্যাগের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে সারা জীবনই তিনি মহত্তর ত্যাগের সাধনা করে গেছেন। তাঁর জীবন, কর্ম ও সাধনা যুগ যুগ ধরে দেশবাসীকে প্রেরণা জোগাবে।



তথ্য সূত্র:

স্বদেশ পরিচয়-জীবন মুখোপাধ্যায়। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

World News

نموذج الاتصال

×