মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি আলোচনা করো | Fall of the
Mughal Empire
বিশালতা, জনসংখ্যা, আর্থিক সম্পদ ও সামরিক বলের দিক থেকে সমগ্র সাম্রাজ্যের বিশ্বের মধ্যযুগের ইতিহাসে মোগল সাম্রাজ্য শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল। ঔরঙ্গজেবের আমলে এই সাম্রাজ্য কাবুল থেকে গৌহাটি এবং কাশ্মীর থেকে ‘সুদূর দক্ষিণ’ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ইতিপূর্বে ভারত ইতিহাসে এত বৃহৎ সাম্রাজ্য আর কখনও স্থাপিত হয়নি। ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর থেকে মোগল সাম্রাজ্য দ্রুত পতনের দিকে অগ্রসর হয় এবং এরপর মাত্র পঞ্চাশ বছরের মধ্যে তা একরকম নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ঐতিহাসিক স্মিথ মন্তব্য করেছেন—“মোগল সাম্রাজ্যের পতন এমন আকস্মিকভাবে হয়েছিল যে, আপাতদৃষ্টিতে তা বিস্ময়কর বলে মনে হয়। কিন্তু ইতিহাসের ছাত্র আশ্চর্য হয়ে ভাববে যে, ঐ সাম্রাজ্য অনেক আগে ভেঙ্গে না পড়ে এত দিন টিকল কি করে।”
মোগল সাম্রাজ্যের দুর্বলতার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল এর স্বৈরতন্ত্রী কাঠামো। মোগল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীভূত স্বৈরতন্ত্রে রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব ও অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে সম্রাটের ব্যক্তিত্ব ও দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ঔরঙ্গজেবের পরবর্তীকালে যে-সব সম্রাটেরা সিংহাসনে বসেন তাঁরা ছিলেন অযোগ্য ও অপদার্থ। তাঁদের দুর্বল শাসনে সাম্রাজ্যের সর্বত্র বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা দেখা দেয়। মোগল রাজবংশে কোনো সুস্পষ্ট উত্তরাধিকার আইন ছিল না। সাধারণভাবে সম্রাট তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করতেন এবং এক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠপুত্রের দাবিই সর্বাগ্রে বিবেচিত হত। অন্যান্য রাজপুত্ররা সর্বদা এই মনোনয়ন মেনে নিতেন না। এর ফলে সাম্রাজ্যকে প্রায়ই উত্তরাধিকারসংক্রান্ত যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হতো।
১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর নয়—ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালেই মোগল সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা হয় এবং এর জন্য দায়ী ছিল সম্রাটের অনুসৃত ভ্রান্ত ও অবাস্তব নীতি। ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্ৰ লিখছেন, “ঔরঙ্গজেবের দীর্ঘস্থায়ী ও দৃঢ় শাসনকালেই মুঘল সাম্রাজ্যের ঐক্য ও স্থায়িত্বের ভিত্তি কেঁপে উঠেছিল।” কেউ কেউ মনে করেন যে, ঔরঙ্গজেবের ভ্রান্তনীতি মোগল সাম্রাজ্যের অবক্ষয় ও পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল। রাজত্বের অধিকাংশ সময় যুদ্ধে লিপ্ত থেকে তিনি দেশের অর্থ, উদ্যম ও শক্তি ক্ষয় করেন। ঔরঙ্গজেবের ভ্রান্ত রাজপুত নীতি, ভ্রান্ত দাক্ষিণাত্য নীতি এবং সংকীর্ণ ধর্মনীতি সাম্রাজ্যের পতন ডেকে আনে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মোগলদের প্রতি বিরূপ হয়ে , উঠেছিল।
প্রথমদিকে যে অভিজাতশ্রেণি ছিল মোগল সাম্রাজ্যের স্তম্ভস্বরূপ, সেই অভিজাতরাই পরবর্তীকালে হয়ে ওঠে সাম্রাজ্যের পক্ষে বিপজ্জনক। স্বার্থান্বেষী অভিজাতরা ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য নিজেদের মধ্যে দলাদলি শুরু করে ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়) ঔরঙ্গজেবের পরবর্তী সময়ে ইরানি, তুরানি ও হিন্দুস্থানি প্রভৃতি গোষ্ঠীগুলি এভাবেই মোগল সাম্রাজ্যের ভিতকে দুর্বল করে দেয়। ভারতে যতদিন মোগল সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যুদ্ধের প্রয়োজন ছিল ততদিনই মোগল সামরিক বাহিনী সক্রিয় ছিল। কিন্তু যখন থেকে যুদ্ধের প্রয়োজন মিটল তখন থেকেই মোগল সামরিক বাহিনী নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়তে থাকল। এই দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় সেনাবাহিনী নিয়ে ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তির মোকাবিলা করা সম্ভব হয়নি।
সপ্তদশ শতকের শেষ ও অষ্টাদশ শতকের প্রথমদিকে মোগল অভিজাত শ্রেণি এক আর্থিক ও সামাজিক সংকটের মুখোমুখি হয়, যা জায়গিরদারি সংকট নামে পরিচিত। জায়গিরের রাজস্ব আদায়ের ঝুঁকি জায়গিরদারকে বহন করতে হত। কিন্তু মোগল শাসনের শেষের দিকে মনসবদারদের সংখ্যা বাড়লেও বণ্টনযোগ্য জমির পরিমাণ বাড়েনি। তাই জায়গিরদাররা যেহেতু তাদের প্রাপ্য বেতনের পুরো অংশ জমি থেকে তুলতে পারত না, তাই তারা নির্ধারিত পুরো সওয়ারও রাখত না। এর ফলে মোগল প্রশাসনিক ব্যবস্থায় তীব্র সংকট দেখা দেয়,। বহু জায়গিরদার এইসময় নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে তাঁদের জায়গির একশ্রেণির লোকের হাতে তুলে দেন। এই লোকেদের বলা হয় ইজারাদার। এই ইজারাদারদের মাত্রাহীন শোষণে বহু কৃষক জমি ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যেত, এইভাবে উদ্ভব হয় কৃষি-সংকটের। এর ফলে মোগল সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত হয়।
মোগল সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ হল কৃষক অসন্তোষ ও কৃষক বিদ্রোহ। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে জায়গীরের নিয়ত হস্তান্তর কৃষকদের অবস্থা শোচনীয় করে তোলে। ইজারা প্রথা প্রবর্তিত হওয়ার নতুন ভূঁইফোড় ইজারাদাররা যথেচ্ছ অত্যাচারের মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে কর আদায় করতে থাকে। এর ফলে ঔরঙ্গজেবের আমল ও তার পরবর্তীকালে অসংখ্য কৃষক বিদ্রোহ দেখা দেয়, যা সাম্রাজ্যের ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়। অভ্যন্তরীণ সংকটে জীর্ণ মোগল সাম্রাজ্যের দুর্বল ভিত্তি নাদির শাহের আক্রমণে কেঁপে ওঠে। নাদির শাহ ভারত আক্রমণ করে (১৭৩৯ খ্রি.) অসংখ্য ভারতবাসীকে নিহত করেন এবং বিপুল ধনসম্পদ লুঠ করে নিয়ে যান।
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কাগজে কলমে মোগল সম্রাটের অস্তিত্ব টিকে ছিল। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের পর ইংরেজরা দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্কে বন্দি ও রেঙ্গুনে নির্বাসিত করলে আনুষ্ঠানিকভাবে মোগল শাসনের অবসান ঘটে। সুতরাং, হঠাৎই আকস্মিকভাবে মোগল সম্রাজ্যের পতন ঘটেনি। দীর্ঘদিনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সমকালীন পরিস্থিতি মোগল সাম্রাজ্যকে পতনের দিকে ধাবিত করে।
তথ্য সূত্র:
১. স্বদেশ পরিচয়- জীবন মুখোপাধ্যায়।
২. ইতিহাস শিক্ষক - অষ্টম শ্রেণী- জে. মুখোপাধ্যায়।
৩. মুঘল রাজ থেকে কোম্পানি রাজ - অধ্যাপক গোপালকৃষ্ণ পাহাড়ী।