অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির গুরুত্ব | Importance of Subsidiary Alliance


অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির গুরুত্ব | Importance of Subsidiary Alliance


ভূমিকা:

ভারতে ইংরেজ আধিপতা সুদৃঢ় করা এবং দেশীয় রাজন্যবর্গকে সম্পূর্ণভাবে কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল করে তোলার উদ্দেশ্যে ঘোরতর সাম্রাজ্যবাদী গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি নামে এক সাম্রাজ্যবাদী নীতি প্রবর্তন করেন। ইওরোপীয় সভ্যতা ও শাসনব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী লর্ড ওয়েলেসলি মনে করতেন যে, ভারতীয় রাজন্যবর্গ অত্যাচারী ও নীতিহীন। এই কারণে কেবলমাত্র ভারতবাসীর সুশাসনের জন্যই সমগ্র ভারতে ব্রিটিশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, “ভারতে ব্রিটিশ শক্তি, প্রতিপত্তি ও প্রভাব বিস্তার করতে পারলেই ভারতবাসীর কল্যাণ সাধন করা হবে।” এ জন্যই তাঁর প্রয়োজন ছিল কোম্পানিকে “ব্রিটিশ ভারতের সার্বভৌম শাসকের আসনে উন্নীত” করা।


দেশীয় রাজ্যের ক্ষেত্রে:

প্রকৃতপক্ষে, ওয়েলেসলি-র এই অধীনতামূলক মিত্ৰতা চুক্তি ছিল একটি ফাঁদ এবং এই ফাঁদে পড়ার অর্থ ছিল কোন রাজা বা রাজ্যের পক্ষে নিজের স্বাধীনতা বিসর্জন দেওয়া। অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করা ছিল পরাধীনতার চুক্তিতে স্বাক্ষর করারই নামান্তর। 


(ক) এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করার পরিণাম ছিল আত্মরক্ষার অধিকারহীনতা, অন্য রাজ্যের সংগে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা বা রক্ষার অধিকারচ্যুতি, এবং রাজ্যের উন্নতির জন্য বিদেশী বিশেষজ্ঞ নিযুক্ত করা বা প্রতিবেশীর সংগে বিবাদ মেটাবার জন্য আলোচনা করার অধিকারচ্যুতি। 


(খ) কেবলমাত্র বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেই নয়,—আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও রাজ্যগুলিকে ক্লীবত্বের পর্যায়ে নামিয়ে আনা হল। ব্রিটিশ রেসিডেন্ট দৈনন্দিন শাসন পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করতেন এবং তাঁকে অমান্য বা উপেক্ষা করার কোন ক্ষমতাই চুক্তিবদ্ধ ‘মিত্র’-দের ছিল না।


(গ) ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ব্যয়নির্বাহের জন্য রাজ্যগুলিকে সাধ্যাতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হত এবং অর্থের দাবী ক্রমেই স্ফীত হয়ে উঠত। এর ফলে রাজ্যগুলির আর্থিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। 


(ঘ) মিত্রতায় আবদ্ধ রাজ্যগুলির নিরাপত্তার দায়িত্ব কোম্পানি গ্রহণ করায় রাজ্যগুলি তাদের সৈন্যসংখ্যা বহু পরিমাণে হ্রাস করে এবং বহুক্ষেত্রে ভেঙ্গে দিতে বাধ্য হয়। পুরুষানুক্রমে সৈনিক বৃত্তিধারী লক্ষ লক্ষ সৈনিক কর্মচ্যুত হওয়ায় রাজ্যগুলিতে দারিদ্র ও নৈতিক অবক্ষয়ের প্রাদুর্ভাব ঘটে। এই সব কর্মচ্যুত সেনাদের অনেকেই ভ্রাম্যমান পিণ্ডারী ও অন্যান্য দস্যুদলে যোগ দিয়ে লুঠতরাজ করে বেড়াতে শুরু করে। প্রায় দুই যুগ ধরে এরা উত্তর ভারতে আতঙ্কের কারণ ছিল। 


(ঙ) কোম্পানি রাজ্যের নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করায় রাজারা প্রজাবিদ্রোহ বা সিংহাসনচ্যুত হবার আশঙ্কা থেকে মুক্ত হয়। প্রজাবর্গের কল্যাণ সাধন করা সম্পর্কে উদাসীন হয়ে তাঁরা বিলাস-ব্যসনে মগ্ন হয়ে পড়েন। মিল বলেন, “নিজেদের দুর্বলতার জন্যই দেশীয় রাজন্যবর্গের অত্যাচার সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু ইংরেজ শক্তির সাহায্য লাভ করায় তাঁদের অত্যাচার সীমাহীন হয়ে পড়ে।” স্যার টমাস মন্‌রো (Sir Thomas Munro) বলেন যে “যেখানেই অধীনতামূলক মিত্রতা ব্যবস্থা প্রবর্তিত হচ্ছে, সেখানেই শ্রীহীন পল্লীগ্রাম এবং ক্রমহ্রাসমান জনসংখ্যা তার চিহ্ন বহন করছে।”


ইংরেজদের ক্ষেত্রে:

এই চুক্তি ইংরেজদের পক্ষে খুবই সুবিধাজনক হয়েছিল। 


(ক) এর দ্বারা কোম্পানির ও সম্পদ যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায় এবং ইংরেজদের পক্ষে সার্বভৌম শক্তিতে পরিণত হওয়া সম্ভব হয়। 


(খ) ভারতীয় শাসকদের অর্থে ইংরেজরা ভারতে এক বিশাল ও সুশিক্ষিত সেনাবাহিনী পোষার সুবিধা পায়- এর জন্য তাদের নিজেদের কোন ব্যয় করতে হত না। 


(গ) চুক্তির পর থেকে কোম্পানি নিজ অধিকৃত স্থান থেকে বহু দূরে— হয় কোন মিত্র রাজ্যভুক্ত অঞ্চলে বা কোন অঞ্চলে যুদ্ধ চালাত। এর ফলে কোম্পানির শাসনাধীন অঞ্চলে শান্তি বজায় থাকত, যা ব্যবসা-বাণিজ্যের পক্ষে অপরিহার্য ছিল।


তথ্য সূত্র:

স্বদেশ পরিচয়-জীবন মুখোপাধ্যায়।






একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

World News

نموذج الاتصال

×