রণজিৎ সিংহের কৃতিত্ব আলোচনা করো | Short Note on Maharaja Ranjit Singh
রণজিৎ সিংহ ভারত ইতিহাসে এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব ছিলেন। শিবাজী ও হায়দার আলির মতো নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও বাহুবল, আত্মবিশ্বাস ও বিচক্ষণতার সাহায্যে বিবদমান শিখরাজ্যগুলির এক বিরাট অংশকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করে তুলতে সক্ষম হন। সততা, ন্যায়বিচার, ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল তাঁর শাসনব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্র-র মতে “রণজিৎ সিংহ শাসিত পাঞ্জাবকে কখনই একটি শিখরাজ্য বলা সঙ্গত হত না।” এই রাজ্যের শাসনব্যবস্থা কেবলমাত্র শিখ-স্বার্থেই প্রযুক্ত হত না।
শিখ জমিদাররা হিন্দু-মুসলিম প্রজাদের সংগে শিখ প্রজাদেরও একইভাবে অত্যাচার করত। তাঁর সেনাবাহিনী কেবল শিখদের নিয়ে গঠিত ছিল না—গুর্খা, বিহারী, পাঠান, ওড়িয়া, ডোগরা, পাঞ্জাবী মুসলমান সকলকে নিয়েই এই সেনাবাহিনী গঠিত ছিল। কামান নির্মাণের জন্য তিনি লাহোরে একটি আধুনিক ঢালাই কারখানা স্থাপন করেন। এটি মুসলিম গোলন্দাজদের দ্বারা পরিচালিত হত। তাঁর বিশিষ্ট মন্ত্রী ও সেনানায়কদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন হিন্দু বা মুসলমান। তাঁর সর্বাপেক্ষা বিশ্বস্ত ও বিশিষ্ট অমাত্য ছিলেন ফকীর আজিজউদ্দিন এবং তাঁর অর্থমন্ত্রী ছিলেন দেওয়ান দীননাথ।
সেনাদলকে আধুনিক প্রথায় শিক্ষিত করে তুলবার উদ্দেশ্যে তিনি বেশ কিছু ফরাসী, ইটালীয়, ইংরেজ, জার্মান, রুশ প্রভৃতি সেনানায়কদের নিযুক্ত ছিলেন। এক সময় তাঁর সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণের কাজে ৩৯ জন ইওরোপীয় নিযুক্ত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে অ্যালার্ড, ভেঞ্চুরা, অ্যাভিটেবিল, কোর্ট প্রভৃতির নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। জনৈক ঐতিহাসিক মন্তব্য করেছেন যে, “সুদক্ষ সেনানায়কদের প্রশিক্ষণের ফলে তাঁর সেনাবাহিনী বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনীতে পরিণত হয়।
ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্র-র মতে, তৎকালে এশিয়া মহাদেশে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনী ছিল প্রথম স্থানের অধিকারী এবং তাঁর সেনাবাহিনীর স্থান ছিল দ্বিতীয়। ফরাসী পর্যটক ভিক্টর জ্যাকিমোঁ তাঁকে “নেপোলিয়নের ক্ষুদ্র সংস্করণ” বলে অভিহিত করেছেন। ঐতিহাসিক স্পীয়ার-এর মতে ঊনবিংশ শতাব্দীর দু’জন অসাধারণ পুরুষের একজন হলেন রামমোহন রায় এবং অপর জন হলেন রণজিৎ সিংহ।
বহু গুণাবলী কৃতিত্বের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও রণজিৎ সিংহের বেশ কিছু ত্রুটিও ছিল।
(১) তিনি কোন যোগ্য উত্তরাধিকারী তৈরি করে যান নি। এর ফলে তাঁর মৃত্যুর পর শিখরাজ্য দ্রুত পতনের দিকে ধাবিত হয়।
(২) তিনি 'খালসা’ সেনাবাহিনীতে নিয়ন্ত্রিত করার ব্যবস্থা করেন নি। এর ফলে তাঁর মৃত্যুর পর ‘খালসা’ বাহিনী প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে রাজ্যকে দুর্বল করে দেয়।
(৩) তিনি বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করেন, কিন্তু পাঞ্জাবের রাজস্ব থেকে তার ব্যয়-নির্বাহ করা সম্ভব ছিল না।
(৪) অনেকের মতে অমৃতসরের সন্ধি স্বাক্ষর করে তিনি ইংরেজদের সংগে সংঘর্ষ এড়িয়ে যান এবং ইংরেজদের মোকাবিলার দায়িত্ব তাঁর দুর্বল উত্তরাধিকারীদের ওপর অর্পণ করেন। বলাবাহুল্য, তাঁর বাস্তববোধই তাঁকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্ররোচিত করেনি। এছাড়া, টিপু সুলতান ও মারাঠা নায়কদের পরিণতি তাঁর স্মরণে ছিল।
তথ্য সূত্র:
স্বদেশ পরিচয়-জীবন মুখোপাধ্যায়।