১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে নৌ বিদ্রোহের কারণগুলি আলোচনা করো


 ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে নৌ বিদ্রোহের কারণগুলি আলোচনা করো 


সূচনা: ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষপর্বে উল্লেখযোগ্য সংগ্রাম হল নৌবিদ্রোহ। আজাদ হিন্দ সেনাদের বীরত্বপূর্ণ লড়াই ভারতীয় নৌসেনাদের বিদ্রোহে অনুপ্রেরণা জোগায়। সিপাহি বিদ্রোহের ৯০ বছর পর ব্রিটিশের বেতনভুক ভারতীয় নৌসেনারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।


নৌ বিদ্রোহের কারণ/ পটভূমি/ প্রেক্ষাপট


১. আই. এন. এ. সেনাদের বিচার:

আই. এন. এ.-র তিন সেনাপতি প্রেম সেহগল, শাহনওয়াজ খান এবং গুরবক্স সিং ধিলনকে বিচারের জন্য দিল্লির লালকেল্লায় নিয়ে আসা হয়। প্রায় দুই মাস ধরে চলা মামলায় আজাদ হিন্দ সেনাদের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের কাহিনি প্রকাশিত হয়। এতে ভারতীয় নৌসেনারা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ হয়।


২. ব্রিটিশ কর্মচারীদের খারাপ ব্যবহার: 

নৌসেনাবাহিনীতে ব্রিটিশ নৌ-অফিসাররা ভারতীয় নৌকর্মচারীদের অকারণে গালিগালাজ, অপমান ও তাদের প্রতি খারাপ ব্যবহার করত। ফলে অপমানিত নৌসেনারা বিদ্রোহী হয়। নৌসেনাবাহিনীর ভারতীয় মাঝি ও মাল্লাদের অত্যন্ত নিম্নমানের খাদ্য দেওয়া হত।


৩. বৈষম্যমূলক আচরণ: 

সমযোগ্যতাসম্পন্ন ভারতীয় নৌকর্মচারীদের ব্রিটিশ কর্মচারীদের থেকে কম বেতন দেওয়া হত। আবার তাদের পদোন্নতির কোনো ব্যবস্থাও থাকত না। চাকরির মেয়াদ শেষে ভারতীয় নৌসেনাদের পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এর ফলে তারা ক্ষুব্ধ হয়।


৪. বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব:

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলে নৌসেনাদের ছাঁটাই করা শুরু হয়। এতে বেকার ভারতীয় নৌসেনারা আর্থিকভাবে বিপদের মুখে পড়ে ক্ষুব্ধ হয়। এছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বিভিন্ন দেশের ঘটনাবলি ভারতীয় নাবিকদের প্রভাবিত করে।


৫. অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলির প্রভাব: 

১৯৪২-এ গান্ধিজির নেতৃত্বে ভারত ছাড়ো আন্দোলন, কলকাতার ছাত্র আন্দোলন, পুলিশবাহিনী ও বিমানবাহিনীর ধর্মঘটের মতো ঘটনা ভারতীয় নাবিকদের প্রভাবিত করেছিল।



বিদ্রোহের সূচনা: 

বোম্বাই বন্দরে ‘তলোয়ার’ জাহাজের রেডিয়ো অপারেটর বলাই দত্তকে দেশাত্মবোধক স্লোগান দেওয়ার অপরাধে ব্রিটিশ নৌকর্তৃপক্ষ পদচ্যুত করে। এর প্রতিবাদে ‘রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভি’র প্রধান এম. এস. খানের নেতৃত্বে দেড় হাজার ভারতীয় নাবিক বিদ্রোহ ঘোষণা করলে সূচনা ঘটে নৌবিদ্রোহের (১৯৪৬ খ্রি. ১৮ ফেব্রুয়ারি)


বিদ্রোহের প্রসার: 

ধীরে ধীরে নৌবিদ্রোহ বোম্বাইয়ের ষাটটি জাহাজে ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহীরা ‘তলোয়ার’ জাহাজের নাম পালটে রাখে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল নেভি'। জাহাজের ব্রিটিশ পতাকা নামিয়ে বিদ্রোহীরা সেখানে জাতীয় কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি ও মুসলিম লিগের পতাকা উড়িয়ে দেয়। বোম্বাই থেকে ধীরে ধীরে এই বিদ্রোহের রেশ ছড়িয়ে পড়ে মাদ্রাজ, করাচি ও কোচিন বন্দরেও।


আন্দোলনের অবসান: 

বিদ্রোহীরা একজোট হয়ে একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে কিছু দাবি জানায়। কিন্তু তাদের সেসব দাবি অগ্রাহ্য করে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সেনাবাহিনী নামিয়ে বিদ্রোহীদের দমন করার চেষ্টা করে। কিন্তু এতেও বিদ্রোহীদের দমন করা যায়নি। অবশেষে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নির্দেশে বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করলে নৌবিদ্রোহের অবসান ঘটে।


মূল্যায়ন: 

নৌবিদ্রোহের মধ্য দিয়ে ভারতীয় নৌসেনারা শেষবারের মতো ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। নৌবিদ্রোহের তীব্রতায় ব্রিটিশ রাজশক্তির মনে ভীতির সঞ্চার ঘটে। ব্রিটিশ সরকার অনুভব করে যে ভারতে তাদের সময় শেষ, এবার তাদের ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে হবে। এটাই নৌবিদ্রোহের বড়ো সাফল্য।


তথ্য সূত্র:

ইতিহাস শিক্ষক- অষ্টম শ্রেণী | জে মুখোপাধ্যায়।

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

World News

نموذج الاتصال

×