স্বাধীনতা আন্দোলনে আজাদ হিন্দ বাহিনীর ভূমিকা/অবদান
সূচনা:
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে আজাদ হিন্দ বাহিনীর অবদান চিরদিন সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। আজাদ হিন্দ সেনাদের আপসহীন লড়াই ভারতের স্বাধীনতার পথকে সুগম করেছিল এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
স্বাধীনতা আন্দোলনে আজাদ হিন্দ বাহিনী:
আই. এন. এ. গঠন:
রাসবিহারী বসুর সভাপতিত্বে ও সিঙ্গাপুরে গঠিত হয় ‘ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘ’। পরে ক্যাপটেন মোহন সিংহের সহযোগিতায় যুদ্ধবন্দি ২৫ হাজার ভারতীয় সেনা নিয়ে গঠিত হয় আই. এন. এ. বা ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি'।
আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠন:
রাসবিহারী বসু সুভাষচন্দ্রকে আই. এন. এ.-র দায়িত্বগ্রহণের আহ্বান জানান। সুভাষচন্দ্র সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে সিঙ্গাপুরে আসেন ও আই. এন. এ.-র নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ‘আজাদ হিন্দ’ নামে এক বিশাল সেনাবাহিনী তৈরি করেন। নেতাজি এরপর তাঁর বাহিনীকে বিভিন্ন ব্রিগেডে ভাগ করেন, যথা—গান্ধি বিগ্রেড, আজাদ বিগ্রেড, সুভাষ বিগ্রেড, নেহরু বিগ্রেড। এ ছাড়াও নারীদের নিয়ে গঠন করেন ঝাঁসির রানি বাহিনী।
আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা:
নেতাজি জাপানের সহযোগিতায় ‘আজাদ হিন্দ সরকার’ নামে অস্থায়ী ভারত সরকার প্রতিষ্ঠা করেন (২১ অক্টোবর)। নবগঠিত এই সরকারকে জাপান, জার্মানি, ইতালিসহ বিশ্বের নয়টি রাষ্ট্র স্বীকৃতি জানায়। জাপানের প্রধানমন্ত্রী নেতাজির হাতে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দুটি তুলে দেন। নেতাজি এই দুই দ্বীপের নাম রাখেন যথাক্রমে শহিদ ও স্বরাজ দ্বীপ।
আজাদ হিন্দ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ:
নেতাজি আজাদ হিন্দ সরকারকে বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করেন এবং বিভিন্ন বিভাগে এক-একজন নেতা নিয়োগ করেন। যেমন—
১. আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক, সমর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী—সুভাষচন্দ্ৰ বসু,
২. মহিলা সংঘের ক্যাপটেন—শ্রীমতী লক্ষ্মী স্বামীনাথন,
৩. প্রকাশনা ও প্রচার বিভাগ—এস. এ. আয়ার,
৪. অর্থ বিভাগ—লে. কর্নেল এ. সি. চ্যাটার্জি,
৫. সচিব— এ. এস. সহায়,
৬. সর্বোচ্চ উপদেষ্টা—রাসবিহারী বসু,
৭. আইন উপদেষ্টা—এ. এন. সরকার।
আজাদ হিন্দ সরকারের লক্ষ্য:
নেতাজি ঘোষণা করেন যে আজাদ হিন্দ সরকারের প্রধান লক্ষ্য হল, ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসনকে উৎখাত করা। এই লক্ষ্যে আজাদ হিন্দ সরকার ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
দিল্লি অভিযান:
নেতাজি রেঙ্গুনে প্রধান সামরিক দপ্তর গড়ে তুলে আজাদ হিন্দ সেনাদের নিয়ে দিল্লি অভিযান শুরু করেন। আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনারা দুর্গম পথ অতিক্রম করে মৌডক নামক ভারত সীমান্তের দখল নেয়। এরপর তারা আরও এগিয়ে মণিপুরের রাজধানী ইম্ফল দখল করে। অবশেষে কোহিমাতে এসে বীর সেনারা ভারতের মাটিতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে।
আত্মসমর্পণ:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির কাছে অক্ষশক্তি হেরে যেতে থাকলে জাপান আজাদ হিন্দ সেনাদের সমস্ত সাহায্য বন্ধ করে দেয়। ইতিমধ্যে প্রবল বর্ষা শুরু হলে আজাদি সেনারা পিছু হঠতে থাকে। অবশেষে তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। .
গুরুত্ব:
১. আজাদ হিন্দ ফৌজ নানা ধর্ম ও জাতির মানুষকে এক জায়গায় এনে একতা ও জাতীয় সংহতির মহৎ আদর্শ স্থাপন করে,
২. এই ফৌজের দেশপ্রেম বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ ভারতীয়দের স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে।
৩. ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের বোম্বাইতে নৌসেনার বিদ্রোহের অনুপ্রেরণা ছিল আজাদ হিন্দ বাহিনীর আত্মত্যাগ।
মূল্যায়ন:
আজাদি সেনাদের বীরত্বপূর্ণ লড়াই ভারতের স্বাধীনতাপ্রাপ্তিকে ত্বরান্বিত করে। তাই গান্ধিজি আজাদ হিন্দ সেনাদের মূল্যায়নে বলেছিলেন, “তারা এমন অনেক কিছুই করেছে যে জন্য তারা গর্ববোধ করতে পারে।”