রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা | রাজা রামমোহন রায়ের অবদান |
ভূমিকা:
ঊনবিংশ শতকে সমাজসংস্কার আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন রামমোহন রায়। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের পাশাপাশি নারীশিক্ষা ও অন্যান্য সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে রামমোহন রায়ের অবদান অস্বীকার করা যায় না। আধুনিক ও সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে এই মহামানব সমাজের কল্যাণে কাজ করে গেছেন।
সমাজ সংস্কার আন্দোলনে রাজা রামমোহন রায়:
১. সতীদাহ প্রথা রদ:
সমাজসংস্কারক রামমোহন রায়ের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘সতীদাহ প্রথা’ রদ। সেসময়কার হিন্দুসমাজে সতীদাহ প্রথায় মৃত স্বামীর চিতায় তার স্ত্রীকে নববধূর সাজে সাজিয়ে জোর করে পুড়িয়ে মারা হত। রামমোহন প্রথম এই প্রথা নিষিদ্ধ করার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলেন। এতে প্রভাবিত হয়ে বড়োলাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক সতীদাহ প্রথাকে বেআইনি ঘোষণা (১৮২৯ খ্রি.) করেন।
২. নারীমুক্তি আন্দোলন:
রামমোহন রায় নারী সমাজের কল্যাণসাধন ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য সর্বপ্রকার বৈষম্যমূলক আচার আচরণের বিরোধিতা করেছিলেন। বাল্য বিবাহ থেকে শুরু করে বহু বিবাহ এবং কৌলিন্য প্রথার তীব্র সমালোচক ছিলেন তিনি।
৩. জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা:
রামমোহন জাতপাতের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সরব হন। তিনি জাতিভেদ প্রথার অসারতা প্রমাণের জন্য ‘বজ্রসূচি’ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ করেন। তিনি অসবর্ণ বিবাহে সমর্থন জানান।
৪. নারীকল্যাণ:
রামমোহনই প্রথম অনুভব করেন যে, সমাজে নারীদের আরও বেশি সুযোগসুবিধা ও মর্যাদা দেওয়া দরকার। তিনি মূলত যেসব নারীসমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিলেন, সেগুলি ছিল-
১. স্বামী বা পিতার সম্পত্তিতে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা,
২. স্ত্রীশিক্ষার সার্বিক প্রসার,
৩. কৌলীন্য প্রথার অনাচার থেকে নারীসমাজকে রক্ষা করা,
৪. বিবাহের ব্যাপারে নির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা ইত্যাদি।
৫. পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার:
ভারতবর্ষে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ন। ১৮১৩ সালের সনদ আইনে ভারতীয়দের শিক্ষার জন্য বার্ষিক এক লক্ষ টাকা ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে রামমোহন রায় এর সমর্থন করেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, একমাত্র পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যমেই ভারতীয়দের মঙ্গলসাধন সম্ভব।
৬. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা:
রামমোহন রায় বহু স্কুল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার সাথেও আংশিকভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৮১৭ সালে ডেভিড হেয়ার কলকাতায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা করলে রামমোহন রায় তাকে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছিলেন। তিনি ১৮২৫ সালে বেদান্ত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শুধু তাই নয় ১৮৩০ সালে আলেকজান্ডার ডাফ জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠা করলে রামমোহন রায় তাকে সহযোগিতা করেছিলেন।
৭. বিভিন্ন গ্রন্থ ও পত্রিকা প্রকাশ:
রামমোহন রায় সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কার ও মানুষের মন থেকে নৈতিক ধ্যান ধারণা দূর করতে নিত্যনতুন বিভিন্ন গ্রন্থ ও পত্রিকা প্রকাশ করতেন। তিনি বাংলা ভাষার 'গৌড়ীয় ব্যাকরণ' রচনা করেন। এছাড়া 'সংবাদ কৌমুদী' ও ' মিরাৎ-উল-আখবার ' নামে পত্রিকা তিনি প্রকাশ করেছিলেন।
মূল্যায়ন:
রাজা রামমোহন রায় তার চিন্তা ও কার্যকলাপের দ্বারা যেভাবে সামাজিক উন্নতি সাধনে প্রয়াস চালিয়েছিলেন তা সত্যি প্রশংসনীয়। আর এই কারণে বহু ঐতিহাসিক রামমোহন রায়কে "আধুনিক ভারতের জনক" বলে অভিহিত করেছেন।