উনিশ শতকে ভারতে সমাজ সংস্কার আন্দোলন সম্পর্কে লেখো


 উনিশ শতকে ভারতে সমাজ সংস্কার আন্দোলন



ভূমিকা:
উনিশ শতকের ভারতে হিন্দু ও মুসলিম সমাজে বেশ কয়েকটি সংস্কার আন্দোলনের সূচনা ঘটে। ব্রায় সমাজ, প্রার্থনা সমাজ, আর্য সমাজ প্রভৃতি সংস্থার নেতৃত্বে এই ধরনের আন্দোলনগুলি গড়ে ওঠে। সমাজসংস্কারক হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, স্যার সৈয়দ আহমেদ খাঁ, শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেব, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

ভারতে সমাজসংস্কার আন্দোলন:

বিভিন্ন সংস্থার ভূমিকা:

১. ব্রাহ্ম সমাজের ভূমিকা: 
রামমোহন রায় ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ‘ব্রাহ্লসভা' নামে এক একেশ্বরবাদী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। দুবছর পরে এর নাম হয় 'ব্রাহ্ম সমাজ'। ব্রা সমাজের নেতৃপদে রামমোহন ছাড়াও ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন। ব্রাহ্ণ সমাজের মূল লক্ষ্য ছিল নারীশিক্ষার বিস্তার ঘটানো ও বিধবাবিবাহ আইনসিদ্ধ করা। কেশবচন্দ্র সেনের প্রচেষ্টায় ব্রিটিশ সরকার তিনটি আইন পাস করিয়ে বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ করে। এ ছাড়াও ব্রাহ্ণ সমাজের প্রচেষ্টায় অসবর্ণ বিবাহের কঠোরতা অনেকাংশে শিথিল হয়।

২. প্রার্থনা সমাজের ভূমিকা: 
আত্মারাম পাণ্ডুরঙ্গ ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে মহারাষ্ট্রে ‘প্রার্থনা সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রার্থনা সমাজের লক্ষ্য ছিল সমাজ থেকে জাতিভেদ প্রথা, পর্দাপ্রথা, অস্পৃশ্যতা, বাল্যবিবাহ প্রভৃতি কুসংস্কার দূর করা। এ ছাড়াও প্রার্থনা সমাজ মহারাষ্ট্রে বিধবাবিবাহ, অসবর্ণ বিবাহ ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত ছিল। পরবর্তীকালে মহাদেব গোবিন্দ রানাডে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বিধবাবিবাহ সমিতি’ ও ‘সার্বজনিক সভা'। এই দুই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাল্যবিধবাদের স্বার্থরক্ষার পাশাপাশি, সমাজের সমস্ত শ্রেণির মানুষের কল্যাণের চেষ্টা করে প্রার্থনা সমাজ।

৩. আর্য সমাজের ভূমিকা: 
১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১০ এপ্রিল স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী বোম্বাইয়ে ‘আর্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। আর্য সমাজ শুদ্ধি আন্দোলনের মাধ্যমে ধর্মান্তরিত হিন্দুদের পুনরায় হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। আর এর মাধ্যমে ভারতকে এক জাতি, এক ধর্ম ও এক সমাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। আর্য সমাজের নেতৃত্বে সমাজে নারীদের সব সুযোগসুবিধা ও স্বাধীনতা দান এবং স্ত্রীশিক্ষার সার্বিক উন্নতির চেষ্টা করা হয়। পাঞ্জাব, গুজরাত, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশের বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে আর্য সমাজ তার সমাজসংস্কার চালায়।

ব্যক্তিগত উদ্যোগ:

১. রামমোহনের উদ্যোগ: 
‘ভারত পথিক’ রামমোহন রায়ের অন্যতম অবদান হল সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্বদান। বড়োলাট উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক রামমোহনের লড়াইকে স্বীকৃতি দিয়ে সতীদাহ প্রথাকে বেআইনি বলে ঘোষণা করেন (১৮২৯ খ্রি.)। এর পাশাপাশি রামমোহন হিন্দুসমাজের জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি স্বামী বা পিতার সম্পত্তিতে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করেন।

২. বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টা: 
নারী স্বাধীনতা ও নারী উন্নয়নে এক উজ্জ্বল নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁর প্রচেষ্টাকে স্বীকৃতি জানিয়ে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ডালহৌসি বিধবাবিবাহ আইন প্রবর্তন করেন। বিদ্যাসাগর বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন প্রথা, কুষ্ঠরোগী হত্যার নিয়ম, জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা ইত্যাদির বিরুদ্ধেও তিনি সরব হন। নারীশিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি একাধিক বালিকা বিদ্যালয় গড়ে তোলেন।


৩. সৈয়দ আহমেদের ভূমিকা: 
সৈয়দ আহমেদ মুসলিম সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ‘আলিগড় আন্দোলন’ গড়ে তোলেন। তিনি মুসলিম সমাজে প্রচলিত তালাক প্রথা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ ইতাদি প্রথার বিরুদ্ধে সরব হন। তিনি যুক্তিবাদের সাহায্যে মুসলিম-সমাজের আধুনিকীকরণের চেষ্টা চালান।

৪. শ্রীশ্রীরামকৃষ্মদেব ও বিবেকানন্দের অবদান: দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দিরের পূজারী ছিলেন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব। সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে তিনি যে বাণীগুলি প্রচার করে গেছেন তা আজও মানবজাতির কাছে সম্পদ। জাতপাতের বেড়া ভেঙে তিনি উদার মানবাদর্শের প্রচার করেন। তাঁর এই আদর্শ অনুসরণ করেই বিবেকানন্দ সমাজসংস্কারে ব্রতী হন। শিবজ্ঞানে জীবসেবার ব্রত নিয়ে বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠা করেন ‘রামকৃষ্ণ মিশন’ (১৮৯৭ খ্রি.)।

মন্তব্য: 
উনিশ শতকের ভারতে সমাজসংস্কারের যে জোয়ার আসে তা উন্নত ভারতের প্রেক্ষাপট রচনা করে। সমষ্টিগত ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রবর্তিত সংস্কার প্রচেষ্টাগুলি ভারতের আধুনিকীকরণে সাহায্য করে।


তথ্য সূত্র:
ইতিহাস শিক্ষক- অষ্টম শ্রেণী | জে মুখোপাধ্যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

World News

نموذج الاتصال

×