ভারতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষের কারণ | Rise of Nationalism in India


ভারতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষের কারণ | ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ভারতে জাতীয় চেতনার উন্মেষের কারণ


ভূমিকা:
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারত ইতিহাসের মূল বৈশিষ্ট্য হল ভারতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ। ব্রিটিশ সরকারের অমানুষিক শোষণ ও নিপীড়নের ফলে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। এ ছাড়াও পাশ্চাত্য শিক্ষা, দেশীয় সংবাদপত্র, রাজনৈতিক সংস্থা, কবি ও সাহিত্যিকদের রচনাবলির মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে।

জাতীয়তাবাদের উন্মেষের বিভিন্ন কারণ:

১. পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার: 
পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ফলে ভারতে জাতীয়তাবাদের পটভূমি রচিত হয়। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ভারতবাসী ইউরোপীয় সাহিত্য, দর্শন ও রাজনীতি, অর্থনীতি, জ্ঞানবিজ্ঞান ও মানবতাবাদ প্রভৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়। এসবের প্রভাবে ভারতবাসীর মনে জন্ম নেয় জাতীয়তাবাদ।

২. জাতিগত বিদ্বেষ: 
ইংরেজরা ভারতীয়দের চেয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠ জাতি বলে মনে করত। হোটেল, পার্ক, রেলের কামরা ও স্টেশন সর্বত্র ইউরোপীয়দের জন্য আসন সংরক্ষিত থাকত। বহু পার্ক ও ইউরোপীয় ক্লাবে লেখা থাকত—কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ। ব্রিটিশের এই হীন আচরণের প্রভাবে ভারতীয়দের মনে ধীরে ধীরে জেগে ওঠে জাতীয়তাবাদ।

৩. আন্তর্জাতিক ঘটনাবলির প্রভাব: 
আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ফরাসি বিপ্লব, ইতালি ও আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা আন্দোলন ইত্যাদি ভারতীয়দের মনে গভীর প্রভাব সৃষ্টি করে। এর পরিণতিতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে।

৪. আর্থিক শোষণ: 
পলাশির যুদ্ধজয়ের পর ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণে সোনা, রুপা ইংল্যান্ডে চালান করা হয়। নিজেদের স্বার্থে ব্রিটিশরা ভারতের কুটিরশিল্প ধ্বংস করে। কঠোর ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা প্রয়োগ ও অতিরিক্ত করের বোঝা চাপানো হলে ভারতবাসীর মনে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে।

৫. সাহিত্য ও সংবাদপত্রের ভূমিকা: 
সে সময়কার সংবাদ প্রভাকর, বঙ্গদর্শন, বেঙ্গলি, অমৃতবাজার প্রভৃতি বিভিন্ন পত্রিকার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী আদর্শ প্রচারিত হয়। এর পাশাপাশি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, নবীনচন্দ্র সেন প্রমুখের সাহিত্যসম্ভার জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় ভারতবাসীকে উদ্বুদ্ধ করে। স্বামী বিবেকানন্দের রচনাবলি এবং বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ' উপন্যাস ভারতবাসীকে জাতীয়তাবাদী মন্ত্রে দীক্ষিত করে।

৬. ব্রিটিশের উদাসীনতা ও বঞ্চনা: 
পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতবাসীর চাকরির নিশ্চয়তার প্রতি ব্রিটিশ সরকার উদাসীন থাকে। উচ্চশিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও অপেক্ষাকৃত নিম্নপদে নিযুক্ত ভারতীয়রা তাদের প্রাপ্য বেতন ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয়। এ ছাড়াও ভারতে ব্রিটিশ শাসন পরিচালনার যাবতীয় খরচ ভারতীয়দের থেকে কর হিসেবে তোলা হয়। পরিবর্তে ভারতবাসী প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়।

৭. ব্রিটিশের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল আইন: 
ব্রিটিশ প্রবর্তিত কিছু প্রতিক্রিয়াশীল আইন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষে সাহায্য করে। পূর্বেকার নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন, সিভিল সার্ভিস আইন, দেশীয় সংবাদপত্র আইন, অস্ত্র আইন ইত্যাদির প্রয়োগ ভারতবাসীর মনে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটায়।

মন্তব্য: 
একদিকে ব্রিটিশ শাসন ও শোষণ অন্যদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার—এই দুইয়ের মিলিত প্রভাবে ভারতবাসী জেগে ওঠে নবচেতনায়।

তথ্য সূত্র:
ইতিহাস শিক্ষক- অষ্টম শ্রেণী | জে মুখোপাধ্যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

World News

نموذج الاتصال

close