ভূমিকা:
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্ববৃহৎ গণ আন্দোলনটি হল ভারত ছাড়ো বা আগস্ট আন্দোলন (১৯৪২ খ্রি.)। ভারতে ব্রিটিশ শাসন অবসানের লক্ষ্যে অন্তিম গণপ্রচেষ্টা ছিল এই আন্দোলন। এই আন্দোলনের পর থেকেই ভারতবাসী বিশ্বাস করতে শুরু করে যে তারা স্বাধীনতা পাচ্ছে। আগস্ট মাসে এই আন্দোলন হয়েছিল বলে একে ‘আগস্ট আন্দোলন’-ও বলা হয়।
ভারত ছাড়ো বা আগস্ট আন্দোলন:
১. পটভূমি:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় ক্রিপস মিশনের ভারতে আগমন ও প্রস্থান, মূল্যবৃদ্ধি, ব্রিটিশের অত্যাচার, জাপানি আগ্রাসনের ভীতি, সর্বোপরি ভারতবাসীর তীব্র স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পটভূমি গড়ে তোলে। গান্ধিজিসহ জাতীয় কংগ্রেসের অন্যান্য নেতারা ব্রিটিশ শাসনের অবসানের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন।
২. প্রস্তাব গ্রহণ:
গান্ধিজি ‘হরিজন' পত্রিকায় ব্রিটিশকে ভারত ত্যাগের পরামর্শ দিয়ে এক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। বোম্বাইয়ে কংগ্রেস কার্যনির্বাহক সমিতি গান্ধিজির পরিকল্পনা মেনে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রস্তাব ঘোষণা করে। এই সমিতি ঘোষণা করে ৯ আগস্ট (১৯৪২ খ্রি.) থেকে ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হবে এবং ইংরেজ ভারত না ছাড়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। গান্ধিজি ঘোষণা করেন—ভারত স্বাধীন করব অথবা মৃত্যুবরণ করব—Do or Die (করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে)।
৩. আন্দোলনের সূচনা:
আগস্ট আন্দোলনের ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পরে গান্ধিজিসহ কংগ্রেসের শীর্ষনেতাদের ব্রিটিশ সরকার গ্রেপ্তার করে। পরের দিন বিভিন্ন সংবাদপত্রে এই খবর প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশ জুড়ে হরতাল, বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। সূচনা ঘটে আগস্ট বা ভারত ছাড়ো আন্দোলনের।
৪. আন্দোলনের বিস্তার:
প্রথমে ভারত ছাড়ো আন্দোলন বোম্বাই, আমেদাবাদ, কলকাতা, পুনা, নাগপুরসহ বিভিন্ন শহরে শুরু হয়। ধীরে ধীরে তা বেশ কিছু গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে। বাংলার কলকাতা, ঢাকা, মেদিনীপুরে আগস্ট আন্দোলন তীব্র আকার নেয়। বিহারের মুঙ্গের, ভাগলপুর, পূর্ণিয়া, যুক্তপ্রদেশের বালিয়া, সুলতানপুর, গোরক্ষপুর, জৌনপুর ইত্যাদি জেলায় এই আন্দোলনের বিস্তার ঘটে। এইভাবে প্রায় সারা ভারতে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
৫. আন্দোলনের ব্যাপকতা:
আন্দোলনকারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ২৫০টি রেলস্টেশন ধ্বংস করে। তাদের হাতে প্রায় ৫০০টি ডাকঘর আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে ৫০টি ডাকঘর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রায় সাড়ে তিন হাজার টেলিগ্রাম ও টেলিফোনের তার বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় এবং ৭০টি থানা ও ৮৫টি অফিসে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। এই আন্দোলনে মেদিনীপুরের তমলুকের ৭৩ বছরের বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা এবং আসামের ১৩ বছরের ছাত্রী কনকলতা বড়ুয়া পুলিশের গুলিতে প্রাণ দেন।
৬. ব্যর্থতা:
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ধীরে ধীরে এই আন্দোলনের তীব্রতা কমতে থাকে। আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতা, নেতৃত্বের অভাব, ব্রিটিশ দমননীতি ইত্যাদি কারণের যোগফলেই এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল।
মূল্যায়ন:
ভারত ছাড়ো আন্দোলন ভারতবাসীর স্বাধীনতার পথ তৈরি করে দিয়েছিল। এই আন্দোলনের শেষে ভারতবাসীর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারে ভারতে তাদের দিন শেষ হয়ে আসছে। তাই বলা হয় ৪২-এর এই আন্দোলন ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মৃত্যু ঘণ্টাধ্বনি শুনিয়েছিল।
তথ্য সূত্র:
ইতিহাস শিক্ষক- অষ্টম শ্রেণী | জে মুখোপাধ্যায়।