ভূমিকা:
গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র জুনা খাঁ মহম্মদ-বিন-তুঘলক নাম ধারণ করে দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন(১৩২৫-৫১ খ্রিঃ)। মহম্মদ-বিন-তুঘলক অসাধারণ মৌলিকত্ব ও সৃজনীশক্তির অধিকারী মহম্মদ-বিন-তুঘলক ছিলেন এক অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ। পাণ্ডিত্য, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও উচ্চ ভাবাদর্শে ভারত ইতিহাসের মধ্যযুগে কোন সুলতানই তাঁর সমকক্ষ ছিলেন না। ঐতিহাসিক লেনপুল-এর মতে, তাঁর ধ্যান-ধারণা ও আদর্শ ছিল যুগের চেয়ে অগ্রণী। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল।
বীর যোদ্ধা, সুদক্ষ শাসক, বুদ্ধিমান, দানশীল, ধর্মনিরপেক্ষ ও উদার-হৃদয় নরপতি হিসেবে তিনি সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিল সমকালীন সর্বপ্রকার কলুষতামুক্ত। বিবিধ উন্নত গুণাবলীর অধিকারী হয়েও কেবলমাত্র ধৈর্যহীনতা, অস্থিরচিত্ততা ও অদূরদর্শিতার জন্য তিনি ‘নিষ্ঠুর', ‘রক্তপিপাসু’—এমনকি ‘উন্মাদ’ হিসেবে অভিহিত হয়েছেন। প্রজাদের মঙ্গলের জন্য তিনি যে সব পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তার পেছনে যথেষ্ট যুক্তি থাকলেও ধৈর্যহীনতা ও বাস্তববুদ্ধির অভাবে তা ব্যর্থ হয়ে প্রজাপীড়নের কারণে রূপান্তরিত হয়।
১. রাজস্ব নীতি:
সিংহাসনে আরোহণের পরেই মহম্মদ-বিন-তুঘলক শাসনব্যবস্থায় কিছু নতুন পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেন। এ সম্পর্কে তাঁর রাজস্বসংক্রান্ত সংস্কার অতি গুরুত্বপূর্ণ। রাজস্ব ব্যবস্থার উন্নতির জন্য তিনি সাম্রাজ্যের আয়-ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন, সাম্রাজ্যের সর্বত্র একই হারে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করেন এবং প্রদেশগুলির আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়মিত দিল্লীতে পাঠাবার জন্য প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয় (১৩২৬-২৭ খ্রিঃ)।
২. দোয়াব অঞ্চলে রাজস্ব বৃদ্ধি:
সাম্রাজ্যের আয়বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে তিনি গঙ্গা-যমুনার দোয়াব অঞ্চলে রাজস্বের হার বহু গুণ বৃদ্ধি করেন (১৬২৬-২৭ খ্রিঃ)। এই সময় কয়েক বছর অনাবৃষ্টির ফলে এই অঞ্চলে ফসল না হওয়ায় কৃষকদের অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিল। সুতরাং কৃষকেরা বর্ধিত কর দিতে অস্বীকৃত হয় এবং রাজকর্মচারীদের উৎপীড়নে কৃষিকার্য পরিত্যাগ করে অনেকে বনে-জঙ্গলে পলায়ন করেন। এর ফলে কৃষিকার্য বন্ধ হয় এবং দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। শেষে কৃষকদের প্রকৃত অবস্থা জানার পর তাদের দুর্দশা লাঘবের জন্য সুলতান তাদের অন্ন, অর্থ ও বীজ, কৃষিঋণদান, রাজস্ব হ্রাস ও জলসেচ প্রভৃতির ব্যবস্থা করেন।
৩. কৃষির উন্নতির চেষ্টা:
কৃষির উন্নতি ও পতিত জমি পুনরুদ্ধারের জন্য তিনি ‘আমীর-ই-কোহী’ নামে একটি কৃষি-বিভাগের পত্তন করেন। দু'বছরে প্রায় সত্তর লক্ষ টাকা ব্যয়ের পর শেষ পর্যন্ত এই পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আসলে যে-সব জমি এই পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত হয়, তা সম্পূর্ণভাবে চাষের অনুপযোগী ছিল। নতুন ধরনের এই পরিকল্পনার সাফল্যের জন্য সুলতানের ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানের প্রয়োজন ছিল, যা কখনই সম্ভব হয় নি। সুলতান স্বয়ং তদারক করতে না পারায় অধিকাংশ অর্থই নষ্ট হয়।
৪. রাজধানী স্থানান্তর:
মহহমদ বিন তুঘলক দিল্লি থেকে দাক্ষিণাত্যের দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর করেন (১৩২৬-২৭) এবং তার নাম রাখেন দৌলতাবাদ। নানা কারণে তিনি এই কাজে উদ্যোগী হন। সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় স্থানে অবস্থিত দেবগিরি রাজধানী হিসেবে নিশ্চয়ই উপযুক্ত ছিল। উত্তরপশ্চিম সীমান্তের সন্নিকটে অবস্থিত হওয়ায় দিল্লীতে সর্বদাই মোঙ্গল আক্রমণের সম্ভাবনা ছিল। দেবগিরিতে কিন্তু তা ছিল না। দেবগিরি থেকে দাক্ষিণাত্যে সুলতানী শাসন পরিচালনা করা সহজতর ছিল।
৫. তামার মুদ্রা প্রচলন:
রাজকোষের অর্থাভাব মেটাবার উদ্দেশ্যে রৌপ্যমুদ্রার পরিবর্তে চীন ও পারস্যের অনুকরণে মহহমদ বিন তুঘলক এক ধরনের ‘প্রতীকী মুদ্রা’ প্রবর্তন করেন (১৩২৯-৩০ খ্রিঃ)। এটি ছিল তাঁর সর্বাপেক্ষা মারাত্মক পরীক্ষামূলক পরিকল্পনা। এই মুদ্রায় ব্যবহৃত ধাতু সম্পর্কে সমকালীন ঐতিহাসিকরা একমত নন। বরণী-র মতে, এই প্রতীক মুদ্রায় তামা ব্যবহৃত হয়েছিল। অপরপক্ষে ফেরিস্তা ব্রোঞ্জের কথা বলেছেন। বিভিন্ন যাদুঘরে রক্ষিত মুদ্রাগুলি দেখে আধুনিক পণ্ডিতরা ব্রোঞ্জের কথাই মেনে নিয়েছেন। সমকালীন ঐতিহাসিকরা এর কারণ সম্পর্কে রাজকোষের ঘাটতি মেটাবার কথা বললেও, আধুনিক ঐতিহাসিকরা বলেন যে, চতুর্দশ শতকে সমগ্র বিশ্বব্যাপী রৌপ্য-সংকট দেখা দেয়, এবং রৌপ্য-সংকটের পরিপেক্ষিতে তিনি ব্রোঞ্জ-মুদ্রা প্রবর্তন করেন।
মূল্যায়ন:
ভারতীয় শাসকদের মধ্যে মহম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন সর্বাপেক্ষা বিতর্কিত একজন ব্যক্তি। তার সমকালীন ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানী, ইবন বতুতা প্রমুখ তার প্রসঙ্গে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। মহম্মদ বিন তুঘলকের খামখেয়ালিপনার দৃষ্টান্ত হিসাবে বারানী দোয়াবে রাজস্ব বৃদ্ধি, দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর এবং তামার মুদ্রা প্রচলনের কথা বলেছেন। আমার কোনো কোনো ঐতিহাসিক সুলতানের এক পরিকল্পনাগুলিকে প্রশংসার চোখে দেখেছেন। সুতরাং মহম্মদ বিন তুঘলকের পরিকল্পনাগুলি সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
তথ্য সূত্র:
স্বদেশ পরিচয় | জীবন মুখোপাধ্যায়।