শাহজাহানের রাজত্বকালকে কী সুবর্নযুগ বলা যায়


শাহজাহানের রাজত্বকালকে কী মোগল সাম্রাজ্যের সুবর্নযুগ বলা যায় | শিল্প ও স্থাপত্যের নিরিখে শাহজাহানের রাজত্বকালকে কী সুবর্ণ যুগ বলা যায়


জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর তাঁর তৃতীয় পুত্র খুরম্ ‘আবুল মুজফ্ফর মহম্মদ শাহজাহান বাদশাহ গাজী’ উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে বসেন (১৬২৭-৫৮ খ্রিঃ)। রাজত্বের প্রথম দিকে তিনি বুন্দেলণ্ডের রাজা ঝুঝর সিংহ (১৬২৮২৯ খ্রিঃ) এবং দাক্ষিণাত্যের প্রাক্তন সুবাদার খান জাহান লোদী-র বিদ্রোহ দমন করেন (১৬২৮-৩১ যিঃ)। এ সময় তাঁকে পর্তুগীজ-দের বিরুদ্ধেও যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়। দিল্লীর সম্রাটের অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশের হুগলীতে বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে বেশ কিছুদিন ধরে তারা ব্যবসা করছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে দেশীয় প্রজাদের জোর করে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করত, অল্পবয়স্ক শিশুদের ধরে নিয়ে তারা ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রী করত এবং দেশীয় প্রজাদের ওপর নানা রকম অত্যাচার চালাত। 


শাহজাহানের নির্দেশে বাংলার সুবাদার কাসিম আলী হুগলী ও চট্টগ্রাম থেকে পর্তুগীজদের উৎখাত করেন। শাহজাহান মধ্য এশিয়ার কান্দাহার, বখ্ ও বদাশান সাময়িককালের জন্য দখল করেন, কিন্তু শীঘ্রই এই স্থানগুলি তাঁর হস্তচ্যুত হয়। জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে দাক্ষিণাত্যের আহম্মদনগর সম্পূর্ণরূপে মোগল সম্রাজ্যভুক্ত হয়নি। নিজাম শাহী বংশের পতন ঘটিয়ে শাহজাহান আহম্মদনগর সম্পূর্ণভাবে সাম্রাজ্যভুক্ত করেন (১৬৩৩ খ্রিঃ)। আহম্মদনগরের পতনের পর গোলকুণ্ডা-র কুতুব শাহী বংশের সুলতান আবদুল্লা কুতুবশাহ মোগলদের বশ্যতা স্বীকার করেন (১৬৩৬ খ্রিঃ)। বিজাপুর-এর আদিল শাহী বংশের সুলতান আদিল শাহ যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে মোগলদের অধীনতা মেনে নিয়ে সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য হন (১৬৩৬ খ্রিঃ)। 


শিল্প ও স্থাপত্য:

শাহজাহানের রাজত্বকাল মোগল স্থাপত্যকলার ইতিহাসে সুবর্ণযুগ। তাঁর উদ্যোগে আগ্রা, দিল্লী, লাহোর, কাবুল, কাশ্মীর প্রভৃতি স্থানে বহু সুরম্য প্রাসাদ, দুর্গ, মসজিদ ও উদ্যান নির্মিত হয়। আকবর ও জাহাঙ্গীরের আমলে নির্মিত সৌধগুলিতে লাল প্রস্তর ব্যবহৃত হত, কিন্তু শাহজাহানের আমলে সর্বত্র মর্মর প্রস্তর ব্যবহৃত হয়। দিল্লীর লালকেল্লা, দেওয়ানে-আম, দেওয়ানে-খাস এবং আগ্রার মতি মসজিদ, জামা-মসজিদ, খাস মহল, শিমহলের গঠন-নৈপুণ্য, শিল্প-রীতি ও অলংকরণ সত্যিই বিস্ময়কর। তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি হল পত্নী মমতাজমহলের স্মৃতিসৌধ শ্বেতমর্মরে তৈরী আগ্রার তাজমহল। আট কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরী মণি-মুক্তাখচিত তাঁর ময়ূর-সিংহাসনটি এক অদ্ভুত সৃষ্টি।


ঐতিহাসিক স্মিথ-এর মতে, শাহজাহানের রাজত্বকাল মোগল সাম্রাজ্য ও বংশের চরমোৎকর্ষের যুগ। বলা হয় যে, ১৬২৭ থেকে ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাহজাহানের ত্রিশ বৎসরের রাজত্বকাল ভারতবর্ষে মোগল শাসনের স্বর্ণযুগ। ঐতিহাসিক হান্টার-এর মতে, ক্ষমতা ও আড়ম্বরের দিক থেকে বিচার করলে শাহজাহানের রাজত্বকালে মোগলবংশ সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেছিল। ঐতিহাসিক এলফিনস্টোন শাহজাহানের রাজত্বকালকে “ভারতের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধশালী” (‘‘the most prosperous known to India'') বলে অভিহিত করেছেন।


শাহজাহানের রাজত্বকালে সমগ্র সাম্রাজ্যে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি বিরাজ করত। রাজকোষ পরিপূর্ণ ছিল এবং কোন বৈদেশিক শক্তি রাজ্যের অস্তিত্ব বিপন্ন করে নি বা তাঁর নিরঙ্কুশ শাসনের বিরুদ্ধে কোন বড় আকারের বিদ্রোহও সংঘটিত হয় নি। এ সময় দাক্ষিণাত্যে মোগল প্রভুত্ব সম্প্রসারিত হয় এবং মোগল সাম্রাজ্য চরম বিস্তৃতি লাভ করে। ব্যবসা-বাণিজ্যের চরম সমৃদ্ধি ঘটে এবং পশ্চিম এশিয়া ও ইওরোপে নতুন নতুন বাণিজ্যের দিক উন্মুক্ত হয়। বহুবিধ ভাস্কর্যের অনিন্দ্য সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্যে এই যুগ ছিল অতুলনীয়। এছাড়া এই যুগে শাহজাহানের পৃষ্ঠপোষকতায় মোগল দরবার শিল্প ও সংস্কৃতির কেন্দ্রে পরিণত হয়। পারসিক, হিন্দী ও সংস্কৃত ভাষায় গদ্য ও কাব্য, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র, চিকিৎসাবিদ্যা—সব কিছুই বিকশিত হয়ে ওঠে। ‘গঙ্গাধর’ ও ‘গঙ্গা লহরী’ কাব্যরচয়িতা জগন্নাথ পণ্ডিত, ‘পাদশাহনামা’ রচয়িতা আব্দুল হামিদ লাহোরী, সংগীতজ্ঞ সুখসেন, জগন্নাথ তাঁর রাজসভা অলংকৃত করতেন। এইসব কারণে তাঁর শাসনকালকে অনায়াসেই ‘সুবর্ণ যুগ' বলে আখ্যায়িত করা যায়।


বলা বাহুল্য, এই যুগের আপাত সমৃদ্ধি ও জাঁক-জমকের আড়ালে সাম্রাজ্যের মৃত্যুর ঘন্টাধ্বনি অস্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছিল। দাক্ষিণাত্য ও গুজরাটের ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ এবং মধ্য এশিয়া ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে অর্থক্ষয়ী ব্যর্থ অভিযানগুলি সাম্রাজ্যের অর্থনীতিতে বিরাট আঘাত হানে। অনেকে শাহজাহানের রাজত্বকালের সঙ্গে ফ্রান্সের চতুর্দশ লুই-এর শাসনকালের তুলনা করে বলেন যে, উভয় সম্রাটের বিরাট আড়ম্বরপ্রিয়— তার আড়ালে সাম্রাজ্যের ধ্বংসের বীজ লুকিয়েছিল। তাই তাঁর রাজত্বকালকে কখনই সুবর্ণ যুগ বা ‘চরমোৎকর্ষের যুগ' হিসাবে আখ্যায়িত করা যায় না—বরং বলা যায় যে, তাঁর রাজত্বকাল থেকেই মোগল সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা হয়—(“It was not a period of climax, but of climacteric")।


তথ্য সূত্র:

স্বদেশ পরিচয় | জীবন মুখোপাধ্যায়।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

World News

نموذج الاتصال

×