ভক্তিবাদের প্রভাব | ভক্তি আন্দোলনের গুরুত্ব | ভক্তি আন্দোলনের ফলাফল
ভারতীয় জনজীবনে ভক্তিবাদ সুগভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কেবলমাত্র সমকালীন ধর্মীয় জীবনই নয়—সমকালীন ও পরবর্তী যুগের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে ভক্তিবাদের প্রভাব ছিল ব্যাপক।
প্রথমত—দীর্ঘদিন ধরে যে হিন্দু-মুসলিম বিভেদ চলছিল ভক্তিবাদের প্রভাবে তার তীব্রতা বহুলাংশে হ্রাস পায় এবং উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হতে থাকে। একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, পরবর্তীকালে সম্রাট আকবরের উদার ধর্মনীতির ভিত্তি এই যুগেই রচিত হয়।
দ্বিতীয়ত—ধর্মাচাৰ্যগণ হিন্দুধর্মে নানা সংস্কার প্রবর্তন করে ইসলামধর্মের অগ্রগতি রোধ করতে সাহায্য করেন।
তৃতীয়ত—ভক্তিবাদের মাধ্যমে সমাজে জাতিভেদ ও উচ্চ-নীচ বৈষম্য বহুলাংশে খর্ব হয় এবং বর্ণাশ্রম ধর্মের কঠোরতা কিছুটা শিথিল হয়।
চতুর্থত—ধর্মাচার্যগণ নারী-পুরুষ ভেদাভেদ মানতেন না। নারীরা অবাধে ধর্মসভায় যোগদান করতেন এবং এর ফলে তাঁদের সামাজিক মর্যাদা পূর্বের চেয়ে বৃদ্ধি পায়।
পঞ্চমত–ধর্মপালনের ক্ষেত্রে সকল বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানকে বর্জন করে ভক্তিবাদীরা অনেক সামাজিক ব্যাধি দূর করতে সক্ষম হন।
ষষ্ঠত—ধর্মপ্রচারকরা সকলেই স্থানীয় ভাষাতেই তাঁদের উপদেশ দান করতেন। এর ফলে এই সব আঞ্চলিক ভাষাগুলি নবীন মর্যাদায় ভূষিত হয়। নামদেব, একনাথ প্রভৃতি সংস্কারকদের পদাবলী মারাঠী সাহিত্যের ভিত্তি স্থাপন করে। কবীরের দোঁহা হিন্দী ভাষা এবং নানকের উপদেশাবলী পাঞ্জাবী ভাষা ও গুরুমুখী লিপিকে সমৃদ্ধ করে। বাংলার বৈষ্ণব কবিরা বাংলা ভাষাকে নতুন রূপ দান করেন।
সপ্তমত—ধর্মপ্রচারকেরা তাঁদের উপদেশ দানকালে সংস্কৃত ভাষায় লিখিত বহু তত্ত্ব ও তথ্য প্রচার করতেন। সেযুগে জনসাধারণের সঙ্গে সংস্কৃতের বিশেষ যোগাযোগ ছিল না এবং তার ফলে জনসাধারণের কাছে ঐ সব তত্ত্ব ও তথ্য অজ্ঞাত ছিল। স্থানীয় ভাষার মাধ্যমে ঐ সব তথ্য ও তত্ত্ব প্রচারিত হওয়ার ফলে জনমানসে ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও ঐতিহ্য সম্পর্কে এক শ্রদ্ধাশীল মনোভাবের সৃষ্টি হয়।
তথ্য সূত্র:
স্বদেশ পরিচয় | জীবন মুখোপাধ্যায়।