দিল্লি সুলতানি স্থাপত্যরীতি সম্পর্কে আলোচনা করো | Delhi Sultanate Architecture


দিল্লি সুলতানি স্থাপত্যরীতি | সুলতানি স্থাপত্য ও ভাস্কর্য | দিল্লি সুলতানি শিল্পকলা


ভূমিকা:

সুলতানী যুগে শিল্পকলার ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। ঐতিহাসিক ফার্গুসন সুলতানী যুগের শিল্পকলাকে ভারতীয় ও আরবীয় শিল্পরীতির সংমিশ্রণ বলে বর্ণনা করেছেন। শিল্প-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হ্যাভেল-এর মতে সুলতানী যুগের শিল্প অন্তরে ও বাইরে পুরোপুরি ভারতীয়। বলা বাহুল্য, এই মন্তব্যগুলি বর্তমানে গ্রহণযোগ্য নয়। স্যার জন মার্শাল-এর মতে, হিন্দু ও মুসলিম প্রতিভার সংমিশ্রণে সুলতানী যুগের শিল্প ও স্থাপত্যের উদ্ভব হয়। তবে এই মিশ্র শিল্প-স্থাপত্যে কোন সভ্যতার প্রভাব কতটুকু তা নির্ণয় করা দুরূহ। হিন্দু-মুসলিম শিল্পরীতির সমন্বয়ের পশ্চাতে একাধিক কারণ বিদ্যমান ছিল: 


(১) দীর্ঘদিন ধরে দুই সম্প্রদায় পাশাপাশি বসবাস করার ফলে একে অন্যের দ্বারা নানাভাবে প্রভাবিত হন। 


(২) মুসলিম শাসকেরা হিন্দু ও জৈন মন্দির ধ্বংস করে তার মাল-মশলা দিয়ে বহু নতুন প্রাসাদ ও মসজিদ নির্মাণ করেন এবং এর ফলে সেগুলিতে হিন্দু ও জৈন প্রভাব দেখা দেয়। 


(৩) অনেক সময় আবার হিন্দু, বৌদ্ধ বা জৈন মন্দির বা মঠগুলির ওপরের অংশ ভেঙ্গে সেখানে ইসলামীয় রীতিতে গম্বুজ তৈরী করে সেগুলিকে মসজিদে পরিণত করা হত। 


(৪) হিন্দু ও মুসলিম স্থাপত্যশিল্প উভয়ই ছিল অলঙ্কারবহুল ও ভাস্কর্যবহুল। এই কারণেও উভয়ের মধ্যে সংমিশ্রণ ঘটে। 


(৫) সর্বশেষে বলা যায় যে, ইসলামীয় শিল্পরীতিতে দক্ষ শিল্পীর অভাবের জন্য মুসলিম শাসকেরা হিন্দু শিল্পী ও স্থপতিদের নিয়োগ করতে বাধ্য হন। এর ফলেও ইসলামীয় শিল্পরীতির সঙ্গে ভারতীয় শিল্পরীতির সমন্বয় ঘটে। এই যুগে তিন ধরনের শিল্প রীতি দেখা যায়।

১. হিন্দু মুসলিম রীতি মিশ্রিত দিল্লির শিল্প রীতি।

২. হিন্দু মুসলিম রীতি মিশ্রিত বিভিন্ন প্রাদেশিক শিল্পরীতি।

৩. মুসলিম প্রভাবমুক্ত হিন্দু শিল্পরীতি।


দিল্লির স্থাপত্যশিল্প:

দিল্লীর সুলতানদের দ্বারা নির্মিত স্থাপত্যগুলিতে এমন কিছু ধরন বা রীতি দেখা যায় যা অন্যত্র অনুপস্থিত। তুর্কীরা তাদের প্রাসাদগুলিতে প্রচুর খিলান ও গম্বুজ ব্যবহার করত। খিলানগুলি ছিল সূক্ষ্ম কারুকার্যমণ্ডিত। এগুলিতে থাকত কোরানের বাণী ও ফুলের সর্পিল অলংকরণ। প্রাসাদ নির্মাণে তারা চুন, বালি ও জলের মিশ্রণে এক ধরণের আস্তর ব্যবহার করত। এর ফলে উত্তর ভারতের স্থাপত্যে এই ধরণের আস্তর ব্যবহার শুরু হয়। এ ছাড়া অলংকরণপ্রিয় তুর্কীরা প্রাসাদ অলংকরণে অবাধে বিভিন্ন হিন্দু বিষয়বস্তু, যেমন পদ্ম, স্বস্তিকা, ঘন্টাকৃতি, বেলকুঁড়ি গ্রহণ করেছিল। ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে দিল্লী জয়ের স্মারক হিসেবে কুতুবউদ্দিন আইবক কুয়াৎ-উল-ইসলাম নামে যে মসজিদটি তৈরী করেন তা অন্তত সাতাশটি হিন্দু ও জৈন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে তৈরী।


কুতুবউদ্দিনের আমলে কুতুব মিনারের নির্মাণ কাজ শুরু হলেও তা শেষ করেন ইলতুৎমিস। ফার্গুসন এই স্তম্ভটিকে ‘পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা সুন্দর ও নিখুঁত স্তম্ভ’-রূপে বর্ণনা করেছেন। ইলতুৎমিসের পরবর্তী দাস-বংশীয় সুলতানদের কোন উল্লেখযোগ্য শিল্পনিদর্শন পাওয়া যায় না। আলাউদ্দিন-এর রাজত্বকালে নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সমাধির ওপর নির্মিত ‘জামাইত খাঁ মসজিদ’-এ মুসলিম শিল্পরীতির চিহ্ন সুস্পষ্ট। জনৈক সমালোচকের মতে, এটি “সম্পূর্ণরূপে মুসলিম ভাবধারা অনুযায়ী নির্মিত ভারতের সর্বপ্রথম মসজিদ।” তাঁর আমলে নির্মিত উল্লেখযোগ্য সৌধ ‘আলাই দরওয়াজা’ ভারতীয় ও মুসলিম শিল্পরীতির এক শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কারুকার্য ও অলঙ্করণের প্রাচুর্য এই সৌধের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। খলজী আমলের স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য হল অলঙ্করণ ও সূক্ষ্ম কারুকার্যের প্রাচুর্য, কিন্তু তুঘলক আমলে অভাব পরিলক্ষিত হয়। এই যুগের স্থাপত্যকীর্তির মধ্যে গিয়াসউদ্দিন তুঘলক স্থাপিত তুঘলকাবাদ শহর, মহম্মদ-বিন-তুঘলক নির্মিত আদিলাবাদের দুর্গ, জাহানপনা শহর এবং ফিরোজ শাহ-এর নির্মিত ফিরোজাবাদের প্রাসাদ, দুর্গ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সৈয়দ ও লোদী আমলে সমাধি-ভবন ব্যতীত অপর কোন উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য কীর্তি নির্মিত হয়নি। এই যুগের স্থাপত্যে ভারতীয় ও ইসলামীয় শিল্পাদর্শের সার্থক প্রয়োগ দেখা যায়। মোগল স্থাপত্যশিল্পে এই ধারার চরম বিকাশ দেখা যায়।


প্রাদেশিক স্থাপত্য রীতি:

দিল্লীর সুলতানদের মত বিভিন্ন প্রদেশের শাসনকর্তারাও শিল্পানুরাগী ছিলেন এবং এর ফলে স্থানীয় প্রভাব ও শাসনকর্তাদের নিজস্ব রুচি অনুসারে বিভিন্ন ধরনের শিল্পরীতির উদ্ভব ঘটে। এগুলির মধ্যে জৌনপুরী, গুজরাটী ও গৌড়ীয় রীতি অতি উল্লেখযোগ্য। জৌনপুরএর স্থাপত্যে হিন্দু প্রভাব অতিরিক্ত, কারণ এখানে হিন্দু মন্দিরগুলিই মূলত মসজিদে রূপান্তরিত হয়। ‘অতালা মসজিদ’-টি জৌনপুরী স্থাপত্যশিল্পের এক অতি উল্লেখযোগ্য জৌনপুর

এর স্থাপত্যে হিন্দু প্রভাব অতিরিক্ত, কারণ এখানে হিন্দু মন্দিরগুলিই মূলত মসজিদে রূপান্তরিত হয়। 


‘অতালা মসজিদ’-টি জৌনপুরী স্থাপত্যশিল্পের এক অতি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। অতালাদেবীর নামে উৎসর্গীকৃত হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে এই মসজিদটি নির্মিত হয়। গুজরাট-এর শিল্পরীতিতে এই যুগে হিন্দু প্রভাব বিদ্যমান ছিল। মুসলিম অনুপ্রবেশের পূর্বেই এখানে এক বিশেষ শিল্পরীতি গড়ে ওঠে এবং মুসলিম শাসকেরা তা অব্যাহত রাখেন। সুলতান আহম্মদ শাহ আহম্মদাবাদে যে সব অট্টালিকা নির্মাণ করেন তার অধিকাংশই হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে তৈরী। 


গুজরাটের জাম-ই-মসজিদের সূক্ষ্ম কারুকার্য স্থানীয় প্রভাবের একটি সুন্দর নিদর্শন। এ ছাড়া কাম্বে, ঢোলকা ও ব্রোচে নির্মিত সুদৃশ্য মসজিদগুলির মূলেও আছে ইসলামীয় ও হিন্দু স্থাপত্য-রীতির সম্মিলিত প্রভাব। মালব-এর পুরাতন রাজধানী ধার-এর মসজিদগুলি হিন্দুরীতিতে তৈরী অট্টালিকার ভগ্নাবশেষ থেকে নির্মিত এবং এই কারণে এগুলিতে হিন্দু শিল্পরীতির ছাপ সুস্পষ্ট। অন্যদিকে মালবের নতুন রাজধানী মাণ্ডুতে নির্মিত স্থাপত্যকীর্তিগুলি দিল্লীর ইসলামীয় স্থাপত্যের রীতিতে তৈরী।  


এগুলির মধ্যে জাম-ই মসজিদ, কামাল মৌলা মসজিদ, হিন্দোলা মহল, রূপমতী মহল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ-এর স্থাপত্যশিল্পে পাথরের পরিবর্তে ইট ব্যবহৃত হত। থামের ওপর চালার আকৃতির খিলানের ব্যবহার বাংলার শিল্পরীতির বৈশিষ্ট্য। বাংলার খড়ের চালার আকারে খিলানগুলি তৈরী হত। ১৩৬৮ খ্রিস্টাব্দে সিকন্দার শাহ নির্মিত পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদ ভারতের অন্যতম বৃহৎ মসজিদ। জালালউদ্দিন মহম্মদ শাহের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত পাণ্ডুয়ার একলাখী সমাধি সৌধ এবং গৌড়ের ছোট সোনা মসজিদ, বড় সোনা মসজিদ, কদম রসুল প্রভৃতি বাংলার স্থাপত্যশিল্পের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। 


দাক্ষিণাত্যের বাহমনী রাজ্যের শিল্পকলায় ভারতীয়, মিশর, ইরান ও তুর্কীস্থানের শিল্পরীতির প্রভাব দেখা যায়। গুলবর্গার জাম-ই-মসজিদ, দৌলতাবাদের চাঁদ মিনার, বিজাপুরে অবস্থিত মহম্মদ আদিল শাহের স্মৃতিসৌধ গোল গম্বুজ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিম বা হিন্দু-মুসলিম শিল্পরীতির বিকাশ ঘটলেও চিরাচরিত হিন্দু শিল্পরীতি কিন্তু একেবারে লুপ্ত হয় নি। রাজপুতানা ও বিজয়নগর-এ হিন্দুরীতিতে বহু স্থাপত্যকীর্তি নির্মিত হয়। বিজয়নগরের বিঠলস্বামীর মন্দির, বিভিন্ন প্রাসাদ ও অট্টালিকা এবং রাজপুতনায় রাণা কুম্ভের স্তম্ভ ও দুর্গ হিন্দু স্থাপত্যরীতির উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। এ প্রসঙ্গে পুরীর জগন্নাথ মন্দির, কোণারকের সূর্যমন্দির প্রভৃতির কথা বলা যায়।


তথ্য সূত্র:

স্বদেশ পরিচয় | জীবন মুখোপাধ্যায়।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

World News

نموذج الاتصال

×