বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের সংঘর্ষে ধর্মের ভূমিকা


  বিজয়নগর ও বাহমনি সাম্রাজ্যের সংঘর্ষে কারণ 


১৩৪৭ খ্রিস্টাব্দে বাহমনী রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর কিছুকাল আগে ১৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্যে বিজয়নগর নামে একটি হিন্দুরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং কালক্রমে তা আয়তনে স্ফীত হয়ে ওঠে। দাক্ষিণাত্যের এই দু'টি শক্তিশালী রাজ্যের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চলে, যার ফলে দু'টি রাজ্যই যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বস্তুতপক্ষে নানা কারণে এই দু'টি রাজ্যের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য ছিল। সংঘর্ষের কারণ হিসেবে অনেকে পরস্পর-বিরোধী দুই ধর্মমতের কথা বলে থাকেন। আবার অনেকে বাহমনী সুলতানদের পক্ষে তুঘলক সাম্রাজ্যের শেষ সীমা মাদুরা পর্যন্ত অগ্রসর হওয়ার উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যের কথা বলেন। 


আপাতদৃষ্টিতে দাক্ষিণাত্যে প্রাধান্য বিস্তার তাদের মধ্যে সংঘর্ষের কারণ বলে মনে হলেও, প্রকৃত কারণ ছিল অর্থনৈতিক। অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতিপূর্ণ তিনটি অঞ্চলের ওপর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষের সুত্রপাত। এই তিনটি অঞ্চল হল—তুঙ্গভদ্রা দোয়াব, কৃষ্ণা, গোদাবরী ব-দ্বীপ এবং মারাঠা রাজ্য। কৃষ্ণা ও তুঙ্গভদ্রা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল তুঙ্গভদ্রা বা রায়চুর দোয়াব বলে পরিচিত। এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্পদের জন্য পূর্ববর্তী যুগে চোল-চালুক্য এবং পরবর্তীকালে যাদব ও হোয়েসলদের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধেছিল। কৃষ্ণা গোদাবরী বন্দ্বীপ অঞ্চল ছিল অতি উর্বর এবং এই অঞ্চলে অনেকগুলি বন্দর থাকায় বহির্বাণিজ্যের দিক থেকেও অঞ্চলটি ছিল খুবই সমৃদ্ধশালী। 


মারাঠা রাজ্যে বিবাদের মূল কারণ ছিল পশ্চিমঘাট পর্বতমালা ও সমুদ্রোপকূলের মধ্যবর্তী উর্বর স্থান কোঙ্কণ ও তার সন্নিহিত বন্দর গোয়া নিয়ে। বহির্বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র গোয়াতে ইরাক ও ইরাণ থেকে উন্নতমানের ঘোড়া আমদানি হত এবং যুদ্ধের প্রযোজনে ভারতীয় ঘোড়া অপেক্ষা তা অনেক বেশী কার্যকর ছিল। এই অঞ্চলের ওপর আধিপত্যের অর্থই হল শক্তিশালী অশ্বারোহী বাহিনী গঠন। বলা বাহুল্য, মূলত এই সব কারণেই দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়।


বিলুপ্তির পূর্ব পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে এই দুই রাজ্যের মধ্যে সংঘর্ষ চলেছিল। বিতর্কিত অঞ্চল এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল জুড়ে আক্রমণ, লুণ্ঠন, হত্যা ও ধ্বংস চলত এবং এর ফলে সাধারণ মানুষের দুর্দশার সীমা থাকত না। ১৩৬৭ খ্রিস্টাব্দে বাহমনী সুলতান প্রথম মহম্মদ শাহের রাজত্বকালে বিজয়নগর-রাজ বুক্ক তুঙ্গভদ্রা দোয়াবে মদগল দুর্গ আক্রমণ করে চরম নৃশংসতার পরিচয় দেন। উত্তেজিত সুলতান অনুরূপভাবে বিজয়নগরের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণ করেন। শোনা যায় যে, এই যুদ্ধেই দু’পক্ষ ভারতে প্রথম কামানের ব্যবহার করেন। দীর্ঘদিনের যুদ্ধে দু’পক্ষেরই প্রভূত ক্ষতি হয় এবং তারা সন্ধিসুত্রে আবদ্ধ হয়। স্থির হয় যে, দু’পক্ষই রায়চুর দোয়াব ভাগাভাগি করে নেবে এবং ভবিষ্যতে কোন পক্ষই আর নৃশংসতাকে প্রশ্রয় দেবে না। বলা বাহুল্য, পরবর্তীকালে দু’পক্ষের যুদ্ধগুলি একেবারে অমানবিক হয়ে ওঠে নি।


পরবর্তীকালে বাহমনী রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের ওপর বিদর, বিজাপুর, আহম্মদনগর, গোলকুণ্ডা ও বেরার প্রভৃতি পাঁচটি রাজ্যের উত্থান ঘটে। এই পাঁচটি রাজ্যের সঙ্গেও বিজয়নগরের সংঘর্ষ লেগেই থাকত—এমনকি তারা সম্মিলিতভাবেও বিজয়নগরের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করত। ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে বিজাপুর, গোলকুণ্ডা, বিদর ও আহম্মদনগর রাজ্যের সম্মিলিত বাহিনী তালিকোটার যুদ্ধে বিজয়নগরকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে এবং এর ফলে বিজয়নগর রাজ্যের সকল গৌরব লুপ্ত হয় — যদিও আরও কিছুকাল এই রাজ্যটি কোনক্রমে টিকে ছিল। 


এই যুদ্ধে পরাজয়ের পর মুসলিম সৈন্যরা পাঁচ মাস ধরে রাজধানী বিজয়নগরে যথেচ্ছ লুন্ঠন চালিয়ে এই নগরীর সকল সমৃদ্ধি বিনষ্ট করে। জনসাধারণের দুর্দশা ছিল সীমাহীন। এর পর মারাঠাদের আবির্ভাব পর্যন্ত দাক্ষিণাত্যে আর কোন হিন্দু-শক্তির উত্থান হয় নি। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের পতন হলেও পাঁচটি স্বাধীন মুসলিম রাজ্যের মধ্যে বিবাদ ও সংঘর্ষ হ্রাস পায় নি এবং এর ফলে দাক্ষিণাত্যে মোগল আধিপত্য বিস্তার সহজতর হয়। বলা বাহুল্য, বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যের পারস্পরিক সম্পর্ককে কেন্দ্র করেই দাক্ষিণাত্যের ইতিহাস বহুলাংশে নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল।


তথ্য সূত্র:

স্বদেশ পরিচয় | জীবন মুখোপাধ্যায়।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

World News

نموذج الاتصال

×