তুর্কী ভাষায় বাবর কথার অর্থ হল ‘ব্যাঘ্র’। ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরউদ্দিন মহম্মদ বাবর প্রকৃতই পুরুষ-সিংহ ছিলেন। ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মধ্য এশিয়ার দুই দুর্ধর্ষ বীরের রক্ত তাঁর ধমনীতে প্রবাহিত ছিল। পিতৃকুলের দিক থেকে বিখ্যাত তুর্কী বীর তৈমুর লঙ এবং মাতৃকুলের দিক থেকে মোঙ্গল বীর চেঙ্গিজ খাঁ তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন। পিতা ওমর শেখ মীর্জা-র মৃত্যুর পর মাত্র বারো বৎসর বয়সে তিনি মধ্য এশিয়ার অন্তর্গত ক্ষুদ্র ফারঘনা রাজ্যের সিংহাসনে বসেন।
১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের প্রথম যুদ্ধের মাধ্যমে বাবর ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতবর্ষে বাবর মাত্র চার বৎসর রাজত্ব করেন এবং এই অল্প সময়ের মধ্যে তিন শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করে তিনি ভারতে একটি নতুন রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত করে তাকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন করে যান। চার বছরের অধিকাংশ সময়ই তিনি যুদ্ধ-বিগ্রহে ব্যাপৃত ছিলেন এবং এই কারণে দেশের মধ্যে নতুন কোন শাসনতান্ত্রিক, বিচার বিভাগীয় বা রাজস্ব সংক্রান্ত সংস্কার সাধন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি—তাঁর রাজ্যের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। জমিদার, জায়গীরদার বা সামন্ত প্রভুরা স্ব স্ব প্রধান ছিলেন— তাদের দমন করা বা কোন কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা গঠন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি।
রাশব্রুক-উইলিয়াস্ মন্তব্য করেন যে, “বাবর তাঁর পুত্রের জন্য যে উত্তরাধিকার রেখে যান তা ছিল দুর্বল, কাঠামোহীন ও মেরুদণ্ডহীন।” এ সত্ত্বেও মোগল সাম্রাজ্যের স্থপতি হিসেবে ভারত ইতিহাসে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। কেবলমাত্র দুঃসাহসী রণনিপুণ যোদ্ধা বা সুচতুর কূটকৌশলী হিসেবেই নয়—বিশ্বস্ত বন্ধু, স্নেহময় পিতা, শিল্প-সাহিত্য ও সংগীতানুরাগী হিসেবেও তিনি স্মরণীয়। ঐতিহাসিক স্মিথ-এর মতে, “সমকালীন যুগে বাবর ছিলেন এশিয়ার নৃপতিগণের মধ্যে সর্বাধিক প্রতিভাসম্পন্ন এবং ভারতীয় রাজন্যবর্গের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ আসনলাভের অধিকারী।”
ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে স্বীকৃত, তুর্কী ভাষায় রচিত বাবরের স্মৃতিকথা “তুজুক-ই-বাবরী” বা “বাবর-নামা” এক অসাধারণ সাহিত্যকীর্তি। তিনি যে জগতে বাস করতেন বা যাদের সঙ্গলাভ করেছিলেন গ্রন্থটি তারই এক বিশ্বস্ত ও প্রাঞ্জল বিবরণ এবং সমকালীন যুগের একটি মূল্যবান ইতিহাস। গ্রন্থটি পরিসংখ্যান-সমন্বিত বিশদ বিবরণে পূর্ণ। তিনি যা করেছিলেন তার একটি সামগ্রিক ও জীবন্ত চিত্র তিনি এই গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। সারল্য, স্পষ্টবাদিতা ও প্রাঞ্জলতা গ্রন্থটির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। কোন কথা গোপন না করে তিনি অকপটে নিজ দোষ-ত্রুটি, ব্যক্তিগত সাফল্য, ব্যথা-বেদনা, বন্ধুপ্রীতি—সবই এই গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। বিভিন্ন দেশ ও জাতির চরিত্র, আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, লতাগুল্ম, বৃক্ষাদি, পশুপক্ষী, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাহাড়, উপত্যকা, নদ-নদী-জঙ্গল সব কিছুর এক প্রাণবন্ত চিত্র গ্রন্থমধ্যে উপস্থিত। এই গ্রন্থের মধ্যে ফুটে উঠেছে বাবরের কাব্যামোদী, প্রকৃতিপ্রেমিক ও স্পর্শকাতর একটি মন।
ঐতিহাসিক বেভারিজ বলেন যে, “বাবরের আত্মজীবনী সেই সব অমূল্য গ্রন্থগুলির মত—যেগুলি সর্বকালের জন্য এবং তা সন্ত অগাস্টাইন ও রুশোর ‘কনফেনসন’ (Confessions) এবং গিবন ও নিউটনের স্মৃতিকথা (Memoirs)-র সম-পর্যায়ভুক্ত।” ঐতিহাসিক লেন-পুল-এর মতে—“বাবরের প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ ও তার গৌরব বিলুপ্ত হয়েছে, কিন্তু তাঁর স্বরচিত জীবনস্মৃতি আজও অমর ও অক্ষয়।” এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে, কেবলমাত্র ‘বাবর-নামা’-ই নয়—তিনি তুর্কী ও ফার্সী ভাষায় কবিতা রচনা করতেন এবং ‘খাত-ই-বাবরী’ নামে এক নতুন তুর্কী হরফ প্রচলন করেন।
তথ্য সূত্র:
স্বদেশ পরিচয় | জীবন মুখোপাধ্যায়।