জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকাররের সংজ্ঞা:
জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বলতে জাতীয় জনসমাজের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের অধিকার বা স্বশাসনের অধিকারকে বোঝায়। একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে কোনো সচেতন জাতীয় জনসমাজ নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও সত্তা রক্ষার দাবী জানালে, তাকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বলা হয়।
জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকাররের পক্ষে যুক্তি:
১. জাতীয় গুণাবলীর বিকাশ:
আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নীতিটি জাতীয় গুণাবলী বিকাশের সহায়ক। প্রত্যেক জাতিরই নিজস্ব সত্তা ও কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। জাতি মাত্রেই চায় তার স্বকীয় পদ্ধতিতে তার গুণগত বৈশিষ্ট্যগুলোর সামগ্রিক বিকাশ। কেবল জাতীয় সরকারের মধ্যেই এই সমস্ত জাতীয় গুণাবলীর পরিপূর্ণ বিকাশ করতে পারে। তাই প্রতিটি জাতির পৃথক রাষ্ট্র প্রয়োজন।
২. বিশ্বসভ্যতার বিকাশ:
জাতির নিজস্ব রাষ্ট্র ও সরকার থাকলে সেই জাতির সভ্যতাসংস্কৃতির বিভিন্ন দিকে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সম্ভব হয়। এইভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি তাদের ভাষা-সাহিত্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রভৃতির প্রভূত উন্নতি সাধনের সুযোগ পাবে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন জাতির নানান বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্যের বিপুল সমাবেশের মাধ্যমে মানবসভ্যতা সম্পদশালী হয়ে উঠবে।
৩. ব্যক্তি-স্বাধীনতার যুক্তি:
ব্যক্তি-স্বাধীনতার স্বার্থেও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতি প্রয়োজন। বহু জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রে বৃহৎ ও সবল জাতিগুলি দুর্বল ও সংখ্যালঘু জাতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই এই ব্যবস্থা ব্যক্তি স্বাধীনতার বিরোধী।
৪. গণতন্ত্রের যুক্তি:
গণতন্ত্রের ভিত্তি হল সর্বসম্মত জনমত। কিন্তু বহু জাতিভিত্তিক গঠিত হতে পারে না। তাই গণতন্ত্রের স্বার্থে জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের দাবিটি মেনে নেওয়া উচিত। তা ছাড়া জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রে একটিমাত্র জাতি বাস করে বলে রাষ্ট্রে সর্বসম্মত জনমত সেই জাতির সকলে নিজেদের সরকার গঠন করতে পারে। বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রে এই সরকার গঠনের সুযোগ সংখ্যালঘু জাতিগুলি পায় না। এই সরকার গঠনের অধিকার নিতান্তই গণতন্ত্রসম্মত।
জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকাররের বিপক্ষে যুক্তি:
বর্তমানে এই তত্ত্বকে সমর্থন করা হয় না। সমালোচকদের মতানুসারে মতবাদটি বাস্তবে রূপায়িত করা অসম্ভব এবং সম্ভব হলেও তা কাম্য নয়।
১. রাষ্ট্রনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে:
জাতীয়তার ভিত্তিতে রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠার নীতি মেনে নিলে পৃথিবীর দীর্ঘকালের সুপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রগুলিকে বহুধা বিভক্ত করে ছোটো ছোটো রাষ্ট্র সৃষ্টি করতে হবে। সুইজারল্যান্ড এমনিতেই ক্ষুদ্রাকৃতির। তার মধ্যে আরও ক্ষুদ্রাকৃতির তিনটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হবে। ইংল্যান্ড চার ভাগে বিভক্ত হবে। ইউরোপে আঠাশটির জায়গায় অন্তত ষাটটি রাষ্ট্রের উদ্ভব হবে। তাহলে বিশ্বজুড়ে জটিল রাষ্ট্রনৈতিক সমস্যা ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে।
২. বাস্তবায়ন কষ্টসাধ্য:
তত্ত্বগতভাবে মেনে নিলেও নীতিটিকে বাস্তবে কার্যকর করা দুরূহ ব্যাপার। একই ভৌগোলিক পরিবেশে বিভিন্ন জাতির মানুষ দীর্ঘদিন ধরে পাশাপাশি বসবাস করার ফলে পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে যায়। তাদের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করা প্রায় অসম্ভব। তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য স্বার্থ একই জায়গায় দৃঢ়মূল হয়ে যায়। এতদ্সত্ত্বেও জাতীয়তার ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলে নব গঠিত ছোটো ছোটো জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু দল থেকে যাবে। জাতীয়তার ভিত্তিতে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছে। ভারতে কিন্তু এখনও বহু মুসলমান আছেন।
৩ উগ্র জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি:
আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকার করলেই যে যুদ্ধ ও সংঘর্ষ দূর হবে, তা নয়। বরং প্রত্যেক জাতিই নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করবে ও অপরকে ঘৃণা করবে। জাতিতে-জাতিতে যুদ্ধের সম্ভাবনা বেশি দেখা দেবে। অর্থাৎ, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার জাতির মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদের বীজবপন করে।
৪. বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা:
এরপরও ছোটো ছোটো জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করলে, তাদের মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হবে। উগ্র জাতীয়তাবাদ হিংসা, দ্বেষ, সংঘর্ষ ও বৈরী মনোভাবের জন্ম দেয়। তার ফলে বিশ্বযুদ্ধের আবহাওয়া সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে।
মূল্যায়ন:
‘আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার’ নীতিটি রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তাজগতে এক জটিলতার সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে এই জটিলতার সুষ্ঠু সমাধান করা যেতে পারে। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের মাধ্যমে না করে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মাধ্যমেও করা যেতে পারে।
তথ্য সূত্র:
১. উচ্চমাধ্যমিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রূপরেখা | অনাদিকুমার মহাপাত্র।
২. উচ্চমাধ্যমিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান সহায়িকা | Tallent Booster | ড. চণ্ডীদাস মুখোপাধ্যায়।