গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণ | গুপ্ত সাম্রাজ্যের ধ্বংসের কারণ
ভূমিকা:
প্রথম চন্দ্রগুপ্ত সমুদ্রগুপ্ত ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের অক্লান্ত চেষ্টায় যে বিশাল গুপ্ত সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল, খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকের শেষভাগ থেকে তা দ্রুত পতনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং খ্রিস্টিয় ষষ্ঠ শতকের মধ্যভাগে তা বিলুপ্ত হয়। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পশ্চাতে নানা কারণ বিদ্যমান ছিল।
১. রাজবংশের দুর্বলতা:
গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের জন্য রাজপরিবারে সিংহাসন নিয়ে অর্ন্তদ্বন্দ্ব এবং রাজন্যবর্গের দুর্বলতা অন্যতম প্রধান কারণ। সম্রাট প্রথম কুমারগুপ্ত-র মৃত্যুর পর সম্ভবত এক সংঘর্ষের মাধ্যমে স্কন্দগুপ্ত সিংহাসনে বসেন। পরবর্তীকালে পুরুগুপ্ত-র মৃত্যুর পর আবার এ ধরনের অর্ন্তদ্বন্দ্ব দেখা দেয় এবং সাম্রাজ্যকে তিনভাগে বিভক্ত করা হয়। সিংহাসনের অধিকার নিয়ে এ ধরনের আর কোন দ্বন্দ্ব হয়েছিল কিনা জানা যায় না, তবে এর ফলে সাম্রাজ্য যে দুর্বল হয়ে পড়েছিল সে সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। এছাড়া, স্কন্দগুপ্তের পরবর্তীকালে যাঁরা সিংহাসনে বসেছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই অযোগ্য ও দুর্বল ছিলেন।
২. ধর্মীয় কারণ:
প্রথম দিকের গুপ্তরাজারা হিন্দুধর্মাবলম্বী ও সমরনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু পরবর্তীকালে বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনের প্রভাবে তাঁদের রণোন্মাদনা যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস পায়। প্রথম কুমারগুপ্ত বৌদ্ধধর্মের দ্বারা প্রভাবিত হন এবং তাঁর শেষ দিকের মুদ্রায় তাঁকে সন্ন্যাসীর বেশে সজ্জিত দেখা যায়। স্কন্দগুপ্ত ও তাঁর রানী যুবরাজ বালাদিত্যকে অধ্যয়নের জন্য বৌদ্দ সন্ন্যাসী বসুবন্ধুর কাছে পাঠান। গুপ্ত রাজপরিবারের ওপর বৌদ্ধ বসুবন্ধুর ব্যাপক প্রভাব ছিল এবং রাজা বালাদিত্য নানাভাবে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ‘আৰ্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ নামক গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, রাজা বালাদিত্য মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করেন—যা বৌদ্ধদের কাম্য, কিন্তু রাজার পক্ষে সম্পূর্ণভাবে অনুচিত। বুধগুপ্ত, তথাগতগুপ্ত, নরসিংহগুপ্ত প্রভৃতি রাজারাও বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন।
৩. আমলাতন্ত্র:
গুপ্তযুগের প্রথম দিকের এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা ধীরে ধীরে আধা-সামন্ততান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রূপান্তরিত হয়। গুগুরাজারা ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য কর্মচারীদের গ্রাম ও ভূমিদান করতেন। এইসব অঞ্চলের শাসন, বিচার, শান্তিরক্ষা, আর্থিক কর্তৃত্ব—এমনকি রাজার একচেটিয়া অধিকার নুন, খনি প্রভৃতির ওপরেও সামন্তদের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। এইভাবে কর্তৃত্বের হস্তান্তর এবং সামন্তদের সংখ্যা ও স্বাধীনতা-বৃদ্ধি রাজকর্তৃত্বকে বহুল পরিমাণে খর্ব করে। গুজরাটের মৈত্রক, কনৌজের মৌখরী বংশ, মান্দাশোরের যশোবর্মন, মহারাজ সুবন্ধু শক্তিশালী সামন্তরাজা ছিলেন।
৪. সামন্তপ্রথা:
মৌর্যদের মত গুপ্ত আমলাতন্ত্র সুসংগঠিত ছিল না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা বেতনের পরিবর্তে ভূমি পেতেন এবং তাঁদের পদও ছিল বংশানুক্রমিক। ভোগিক, মন্ত্রিণ, সচিব, অমাত্য এবং বহুক্ষেত্রে প্রাদেশিক শাসনকর্তার পদ বংশানুক্রমিক ছিল। এর ফলে সাম্রাজ্য দুর্বল হতে বাধ্য ছিল। এছাড়া, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমল থেকে রাজসভায় বিলাস-বৈভব বৃদ্ধি পায়। তাঁর সভায় সাহিত্য ও শিল্পচর্চা অপেক্ষা রাষ্ট্রনীতি বা সমরনীতির চর্চা ছিল খুবই কম।
৫. স্থায়ী সেনাবাহিনীর অভাব:
গুপ্তদের কোন স্থায়ী সৈন্যবাহিনী ছিল না। সমুদ্রগুপ্তের বিজয়াভিযানের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়, কিন্তু তাঁর সেনাবাহিনীর কথা কোথাও উল্লেখ নেই। সেনাবাহিনীর জন্য গুপ্তরা সম্পূর্ণভাবে সামন্তদের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন—সম্রাটের প্রয়োজনে সামন্তরা সেনা পাঠাতেন। যুদ্ধের অন্যতম প্রধান সরঞ্জাম হাতি ও ঘোড়ার ওপরেও সম্রাটের কোন একচেটিয়া কর্তৃত্ব ছিল না। এই অবস্থায় কোন সাম্রাজ্য দীর্ঘস্থায়ী হওয়া সম্ভব ছিল না এবং গুপ্তদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল।
৬. বৈদেশিক আক্রমণ:
পুষ্যমিত্র, বাকাটক ও হুন জাতির ক্রমাগত আক্রমণে সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।প্রথম কুমারগুপ্তের আমলে পুষ্যমিত্রদের আক্রমণ ভয়ঙ্কর আকৃতি ধারণ করে। বুধগুপ্তের আমল থেকে বাকাটক জাতি সাম্রাজ্য আক্রমণ করতে শুরু করলে মধ্য ভারতে গুপ্ত আধিপত্য প্রবলভাবে খর্ব হয়। স্কন্দগুপ্ত ও তাঁর পরবর্তীকালে হুনদের .: ক্রমাগত আক্রমণে গুপ্ত সাম্রাজ্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অনেকের মতে হূন আক্রমণই গুপ্তদের পতনের প্রধান কারণ—যদিও ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার এই মতের পক্ষপাতী নন। তাঁর মতে হূন আক্রমণ প্রতিহত হয়েছিল—যদিও একথা ঠিকই যে, হূণ আক্রমণে সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে, সাম্রাজ্যের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায় এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলের শাসনকর্তারা বিদ্রোহে অনুপ্রাণিত হন।
৭. প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা:
বৈদেশিক আক্রমণের ফলে সাম্রাজ্যের দুর্বলতা ও গোলযোগের সুযোগ নিয়ে মান্দাশোরের শাসনকর্তা যশোধর্মন গুপ্ত আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং অচিরেই কনৌজে মৌখরী বংশ, বলভীতে মৈত্ৰকবংশ, মগধে পরবর্তী-গুপ্তবংশ এবং অন্যান্য প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেন। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন যে, হূণ আক্রমণ নয়, প্রকৃতপক্ষে যশোধর্মন-ই গুপ্ত সাম্রাজ্যের ওপর মৃত্যু-আঘাত হেনেছিলেন।
৮. অর্থনৈতিক বিপর্যয়:
বহিঃশত্রুর আক্রমণে সাম্রাজ্যের আর্থিক বনিয়াদ ভেঙ্গে পড়েছিল। হূন আক্রমণে বিপর্যস্ত স্কন্দগুপ্ত তাঁর রাজত্বের শেষদিকে খাদ মেশান স্বর্ণমুদ্রা প্রচলন করতে বাধ্য হন। এ ছাড়া, গুপ্ত শাসনের শেষদিকে তামা ও রূপার মুদ্রা অপেক্ষা সাম্রাজ্যে স্বর্ণমুদ্রার আধিক্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের ইঙ্গিত বহন করে। চীনাংশুকের আবিষ্কার ভারতের রেশম বাণিজ্যে তীব্র আঘাত হানে। খ্রিস্টিয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে বর্বর আক্রমণের ফলে রোম সাম্রাজ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং রোমের সঙ্গে বাণিজ্য নষ্ট হলে ভারতীয় অর্থনীতি যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া, বিভিন্ন অঞ্চলের স্বাধীনতা ঘোষণার ফলে গুপ্তরা ঐ সব অঞ্চলের রাজস্ব থেকেও বঞ্চিত হন।
তথ্য সূত্র:
স্বদেশ পরিচয় | জীবন মুখোপাধ্যায়।