কুষাণ যুগের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব | কুষাণ যুগের অবদান | কুষাণ যুগের সাংস্কৃতিক অগ্রগতি
ভূমিকা:
ডঃ দীনেশচন্দ্র সরকারের মতে কুষাণ যুগ ভারত ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মৌর্য শাসনের পতনের পর রাজনৈতিক অনৈক্য ও হানাহানির যুগে কুষাণরা পশ্চিমে খোরাসান থেকে পূর্বে বারাণসী এবং উত্তরে খোটান থেকে দক্ষিণে কোঙ্কণ পর্যন্ত সুবিশাল এক স্থানে আবার রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়। কেবলমাত্র রাষ্ট্রীয় ঐক্যই নয় – দেশময় অশান্তি ও অরাজকতার দিনে কুষাণরা ভারতে এক সুশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থা স্থাপন করে, যা কয়েক শতাব্দী ধরে ভারতে প্রচলিত ছিল।
১. মিশ্র সংষ্কৃতি:
ঐতিহাসিক রলিনসন-এর মতে, ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে কুষাণ যুগ বিশেষ ‘গুরুত্বপূর্ণ’। বি. জি. গোখলে বলেন যে, সাংস্কৃতিক দিক থেকে কুষাণ যুগ ভারত ইতিহাসে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ।' দেশী-বিদেশী, বিভিন্ন জাতি-উপজাতি ও আঞ্চলিক সংস্কৃতির সমন্বয়ে এই যুগে ভারতে এক মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এই সংমিশ্রণ বা সমন্বয়ই হল কুষাণ যুগের সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। লিপি, ধর্ম, মুদ্রা, শিল্প—সাংস্কৃতিক জীবনের সর্বক্ষেত্রেই এই বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়।
২. ধর্ম:
কুষাণ যুগ ‘ধর্মীয় পুনরুত্থানের যুগ' হিসেবে চিহ্নিত। এই যুগে শৈব, বৈষ্ণব, মিহির, কার্তিকেয় প্রভৃতি ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ পরিলক্ষিত হয়। রাজারা বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক হওয়া সত্ত্বেও পরধর্মমতসহিষ্ণু ছিলেন এবং তাঁদের মুদ্রায় অংকিত গ্রীক, ইরাণীয় ও বিভিন্ন ভারতীয় দেবদেবীর মূর্তিই তার প্রমাণ। রাজানুগ্রহে বৌদ্ধধর্ম এই যুগে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং বৌদ্ধধর্মে ‘মহাযান’ ধর্মমতের উদ্ভব ঘটে। মহাযানপন্থীরা বুদ্ধের মূর্তিপূজা প্রচলন করেন এবং বৌদ্ধধর্মের সৎকর্মের পরিবর্তে তাঁরা বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বদের পূজার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
৩. বহির্বিশ্বে ভারতীয় সংস্কৃতি:
অশোকের অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করে কণিষ্ক বৌদ্ধধর্ম ও ভারতীয় সংস্কৃতি বহির্বিশ্বে মধ্য এশিয়ার কাশগড়, খোটান, তিব্বত, চীন ও জাপানে প্রচারিত করেন। স্যার অরেলস্টাইনের চেষ্টায় মধ্য এশিয়ায় প্রচুর ভারতীয় উপনিবেশ আবিষ্কৃত হয়েছে। এই যুগেই এশিয়া ও ইওরোপের বাণিজ্যকেন্দ্রগুলি সর্বপ্রথম বৌদ্ধধর্মের সংস্পর্শে আসে। কুষাণদের ধর্মপ্রচার ও রাজনৈতিক প্রভাবের ফলে বৌদ্ধধর্ম মধ্য এশিয়ার বর্বর জাতিগুলির একমাত্র ধর্ম এবং ভারতবর্ষ সমগ্র এশিয়ার তীর্থক্ষেত্র পরিণত হয়। সুদূর প্রাচ্যের দ্বীপগুলিতে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিস্তৃত হয় এবং বেশ কিছু ভারতীয় উপনিবেশ স্থাপিত হয়। রোম, মিশর প্রভৃতি দেশের সঙ্গেও ভারতের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হয়।
৪. সাহিত্য:
সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এই যুগে যথেষ্ট উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। পালির পরিবর্তে এই যুগে সংস্কৃত ভাষার ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। রাজারা শিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। অশ্বঘোষ, নাগার্জুন, পার্শ্ব, বসুমিত্র, আয়ুর্বেদাচার্য চরক প্রভৃতি পণ্ডিত ও দার্শনিক কণিষ্কের রাজসভা অলংকৃত করেছিলেন। বিখ্যাত কবি, দার্শনিক, সংগীতজ্ঞ ও শাস্ত্রজ্ঞ অশ্বঘোষ রচিত ‘বুদ্ধচরিত’, ‘সূত্রালংকার’, ‘বজ্রসূচী’ ও ‘সৌন্দরানন্দ কাব্য’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কেবলমাত্র সাহিত্যই নয় – ধর্ম ও দর্শনের ক্ষেত্রেও তিনি নতুন ভাবধারার প্রবর্তক ছিলেন। ‘শত-সহস্রিকা প্রজ্ঞা-পারমিতা’ ও ‘মাধ্যমিক–সূত্র’ গ্রন্থের রচয়িতা নাগার্জুন কেবলমাত্র সাহিত্যিক বা দার্শনিকই ছিলেন না—তিনি ছিলেন একজন কৃতী বৈজ্ঞানিক।
৫. শিল্প:
শিল্পকলার ইতিহাসে কুষাণ যুগ এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। সারনাথ, মথুরা, অমরাবতী গান্ধার প্রভৃতি স্থানে চারটি বিশিষ্ট শিল্পরীতির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। এদের মধ্যে গান্ধার শিল্পই সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। গান্ধার শিল্প হল ভারতীয়, গ্রীক ও রোমান শিল্পরীতির এক বিস্ময়কর সমন্বয়। গান্ধার শিল্পের প্রভাব মধ্য এশিয়ার পথে চীন পর্যন্ত এবং জলপথে ইন্দো-চীনেও প্রসারিত হয়। শিল্পের পৃষ্ঠপোষক কুষাণ রাজাদের চেষ্টায় পুরুষপুর, মথুরা, কণিষ্কপুর, তক্ষশীলা প্রভৃতি স্থানে বহু বিস্ময়কর শিল্পকীর্তি নির্মিত হয়েছে।
৬. ব্যাবসা বাণিজ্য:
কুষাণ যুগে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। মধ্য এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়ায় ভারতীয় বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়। কুষাণ রাজারাই এদেশে সর্বপ্রথম স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেন। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটে। মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্থানের ভেতর দিয়ে চীনের সিল্ক ইরান ও রোম সাম্রাজ্যে নিয়ে যাওয়া হত। এই বিখ্যাত ‘রেশম পথ’ বা ‘Silk Route' কুষাণ সাম্রাজ্যের মধ্যে থাকায় বণিকদের কাছ থেকে প্রচুর শুল্ক আদায় করে কুষাণ সাম্রাজ্য লাভবান হয়েছিল।
উপসংহার:
এক কথায়, ভারত ইতিহাসে কুষাণ যুগ এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। দীর্ঘদিনের অশান্তি, পর এই যুগ শান্তি, সমৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক পুনরুত্থানের অনৈক্য ও রাজনৈতিক হানাহানির যুগ হিসেবে চিহ্নিত। এই যুগকে ‘গুপ্তযুগের মুখবন্ধ’ বললে অত্যুক্তি হয় না।