গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর কৃতিত্ব | গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর অবদান | সাতবাহন রাজাদের কৃতিত্ব
প্রথম সাতকর্ণীর মৃত্যুর একশ’ বছর পরে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী (১০৬–১৩০ খ্রিঃ) সাতবাহন সিংহাসনে বসেন। তাঁর আবির্ভাবে সাতবাহন শক্তি নববলে বলীয়ান হয়ে ওঠে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর মা গৌতমী বলশ্রী তাঁর কীর্তিমান পুত্রের যশোগৌরবের বিবরণ দিয়ে নাসিক প্রশস্তি রচনা করেন। সন্তানহারা মাতার এই আর্তি ঐতিহাসিকদের কাছে অতি মূল্যবান। অসাধারণ সামরিক প্রতিভার অধিকারী গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী সাতবাহন বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি ছিলেন। মহারাষ্ট্র ও সন্নিহিত অঞ্চলসমূহ পুনরুদ্ধার করে তিনি সাতবাহনদের লুপ্তগৌরব পুনরুদ্ধার করেন।
নাসিক প্রশস্তিতে গৌতমীপুত্রকে ‘সাতবাহন-কুল-যশঃ প্রতিষ্ঠানকর’ অর্থাৎ সাতবাহনদের যশঃ প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়েছে। কেবলমাত্র মহারাষ্ট্র জয়ই নয়, তিনি অন্যান্য স্থানও জয় করেন। নাসিক প্রশস্তিতে তাঁকে ‘শক-যবন-পহ্লব-নিসূদন’ বলা হয়েছে। যবন ও পহ্লব অর্থ হল যথাক্রমে গ্রীক ও পার্থিয়ান। বলা বাহুল্য, গ্রীক ও পার্থিয়ানদের সঙ্গে তাঁর সংঘর্ষের কোন বিবরণ জানা যায় না—তবে শকদের রাজা নহপান-কে পরাজিত করে তিনি গুজরাট, সৌরাষ্ট্র, মালব, বেরার ও উত্তর কোঙ্কণ দখল করেন। শকদের বিরুদ্ধে তাঁর সাফল্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
শকদের অন্য এক শাখার অধিপতি রুদ্রদামন তাঁকে পরাজিত করে নহপানের কাছ থেকে অধিকৃত সকল স্থান ছিনিয়ে নেন। শক আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার আশায় তিনি নিজ পুত্র বশিষ্ঠীপুত্র সাতকর্ণীর সঙ্গে রুদ্রদামনের কন্যার বিবাহ দেন। নাসিক প্রশস্তিতে তাঁর অধীনস্থ স্থানগুলির উল্লেখ আছে। সেই স্থানগুলি হল— আসিক (মহারাষ্ট্র), মুলক (পৈথানের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল), সুরথ (কাথিয়াওয়াড়), কুকুর (উত্তর কাথিয়াওয়াড়), অনুপ (নর্মদা নদীর তীরে মাহিশ্মতী), বিদর্ভ (বেরার), আকর (পূর্ব মালব), অবন্তী (পশ্চিম মালব)।
নাসিক প্রশস্তিতে তাঁকে বিন্ধ্য পর্বত থেকে মলয় পর্বত ও পূর্বঘাট থেকে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত স্থানের অধিপতি বলা হয়েছে। ডঃ দীনেশচন্দ্র সরকারের মতে, তিনি বিন্ধ্যের দক্ষিণস্থ সকল ভূভাগের অধিপতি ছিলেন। গৌতমীপুত্র নিজেকে ‘ত্রি-সমুদ্র-তোয়-পীত-বাহন' অর্থাৎ যাঁর সেনাদল তিন সমুদ্রের (আরব সাগর, ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর) জল পান করেছেন বলে অভিহিত করেছেন। বলা বাহুল্য, এ দাবী অযৌক্তিক। তাঁর প্রত্যক্ষ শাসন কৃষ্ণা উপত্যকা থেকে কাথিয়াওয়াড় এবং বেরার থেকে কোঙ্কণ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
কেবলমাত্র রাজ্যবিজেতা হিসেবেই নয়—সুশাসক, প্রজাহিতৈষী, শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত, সমাজ সংস্কারক ও স্থপতি হিসেবেও গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী স্মরণীয়। নাসিক প্রশস্তিতে উল্লিখিত আছে যে, তিনি ক্ষত্রিয়দের দর্প চূর্ণ করেন, বর্ণাশ্রম ধর্ম ও চতুর্বণকে রক্ষা করেন, ব্রাহ্মণ ও নিম্নশ্রেণীর উন্নতি বিধান করেন এবং বিভিন্ন জাতির মধ্যে রক্তের মিশ্রণ বন্ধ করেন। ব্রাহ্মণ্যধর্মের পৃষ্ঠপোষক হলেও বৌদ্ধদের প্রতি তিনি উদার ছিলেন। কার্লে, নাসিক প্রভৃতি স্থানে বিহারবাসীদের তিনি ভূমি ও গুহা দান করেন। তাঁকে অনেকে ভারতীয় উপকথার ‘বিক্রমাদিত্য’ ও ‘শালিবহন' হিসেবে চিহ্নিত করেন, কিন্তু এ মত ঠিক নয়। তিনি ‘বর-বরণ-বিক্রমচারু-বিক্রম' উপাধি ধারণ করেন, কিন্তু ‘বিক্রমাদিত্য’ ও এই উপাধি কখনই এক নয়।