ভূমিকা:
গৌড়রাজ শশাঙ্কের হস্তে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর মাত্র ষোল বছর বয়সে হর্ষবর্ধন থানেশ্বরের পুষ্যভূতি বংশের সিংহাসনে বসেন (৬০৬ খ্রিঃ)। গ্রহবর্মার মৃত্যুতে কনৌজের সিংহাসন তখন শূন্য থাকায় কনৌজের শাসনভারও তিনি গ্রহণ করেন। এই যুগ্মরাজ্যের রাজধানী নির্বাচিত হয় কনৌজ। এ সময় থেকে কনৌজ উত্তর ভারতের সকল রাজনৈতিক কার্যকলাপের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। নিজের সিংহাসনারোহণ কালকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এ সময় অর্থাৎ ৬০৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে তিনি একটি নতুন বর্ষ গণনা বা অব্দের প্রচলন করেন। তার নাম হর্ষাব্দ।
রাজ্য জয়:
হিউয়েন সাঙ্ বলেন যে, সিংহাসনারোহণের পর ছয় বছরের মধ্যে তিনি সমগ্র আর্যাবর্তে তাঁর সর্বময় প্রভুত্ব স্থাপন করেন। বলা বাহুল্য, এই মত ইতিহাস-সম্মত নয়। তিনি সর্বপ্রথম তাঁর প্রবলতম প্রতিদ্বন্দ্বী গৌড়রাজ শশাঙ্ক-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। বাণভট্ট হিউয়েন সাঙ্ কারো রচনাতেই এই যুদ্ধের কোন বিবরণ নেই। শশাঙ্কের আক্রমণাত্মক মনোভাবে ভীত কামরূপ-রাজ ভাস্করবর্মণের সঙ্গে তিনি মিত্রতা স্থাপন করেন, কিন্তু শশাঙ্কের জীবিতাবস্থায় তাঁদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর (৬৩৭ খ্রিঃ) তিনি মগধ, উড়িষ্যা, কঙ্গোদ ও পশ্চিমবঙ্গ জয় করেন। শশাঙ্কের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গ কামরূপ-রাজ ভাস্করবর্মণের রাজ্যভুক্ত হয়। পশ্চিম ভারতে বলভী রাজ্যের (গুজরাট) মৈত্রকবংশীয় রাজা দ্বিতীয় ধ্রুবসেন-এর বিরুদ্ধে সাফল্য লাভের পর ধ্রুবসেনের সঙ্গে নিজ কন্যার বিবাহ দিয়ে তিনি মিত্ৰতা স্থাপন করেন! দাক্ষিণাত্য জয়ের উদ্দেশ্যে হর্ষ এক অভিযান পাঠান, কিন্তু বাতাপির চালুক্যবংশীয় রাজা দ্বিতীয় পুলকেশী-র কাছে পরাজিত হয়ে তিনি ফিরে আসেন। তিনি সিন্ধুদেশ ও কাশ্মীর-এর বিরুদ্ধেও অভিযান পাঠান, কিন্তু তা সফল হয় নি।
রাষ্ট্রীয় ঐক্য:
প্রতিভাসম্পন্ন এক সমরকুশলী ও প্রজাহিতৈষী নরপতি। তাঁর রচিত ‘নাগানন্দ’, ‘রত্নাবলী’ ও ‘প্রিয়দর্শিকা’ নাটক সংস্কৃত সাহিত্যের মূল্যবান সম্পদ। হর্ষবর্ধন ছিলেন অসাধারণ গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর উত্তর ভারত বেশ কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়লে হর্ষবর্ধন এ সময় অন্তত কিছু কালের জন্য উত্তর ভারতের কিছু অংশে রাষ্ট্রীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করেন ও দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপন করেন। তাঁরই চেষ্টায় কনৌজ ‘মহোদয়শ্রী’ অভিধায় ভূষিত হয় ও পাটলিপুত্রের গৌরব হরণ করে। কেবলমাত্র রণকুশলী সমরনায়ক বা দক্ষ প্রশাসকই নন—তিনি ছিলেন সুপণ্ডিত এবং শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। তিনি স্বয়ং একজন বিশিষ্ট কবি ও নাট্যকার ছিলেন।
শিক্ষা ও সাহিত্য:
হিউয়েন সাঙের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, তিনি সাহিত্যসেবীদের জন্য রাজস্বের একচতুর্থাংশ ব্যয় করতেন। বহু বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক তাঁর রাজসভা অলংকৃত করতেন। ‘কাদম্বরী’ ও ‘হর্ষচরিত’ রচয়িতা বাণভট্ট তাঁর সভাকবি ছিলেন। এছাড়া, জয়সেন, ময়ূর, দিবাকর, কবি মৌর্য ও কবি ভর্তৃহরি তাঁর সভা অলংকৃত করতেন। এই যুগে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বৌদ্ধ-বিদ্যাচর্চার শ্রেষ্ঠ পীঠস্থান ছিল এবং হর্ষবর্ধন এখানে মুক্তহস্তে দান করতেন।
ধর্মমত:
হিউয়েন সাঙের বিবরণ থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, ধর্মবিশ্বাসে হর্ষ বৌদ্ধ ছিলেন, কিন্তু তা সঠিক নয়। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার ও অন্যান্য ঐতিহাসিকেরা মনে করেন যে, বৌদ্ধধর্মের প্রতি অনুরক্ত হলেও তিনি বৌদ্ধ ছিলেন না—আজীবন তিনি ছিলেন শিব ও সূর্যের উপাসক এবং সকল ধর্মের প্রতি সহনশীল।
প্রজাহিতৈষী শাসক:
তিনি একজন প্রজাহিতৈষী নরপতি ছিলেন। হিউয়েন সাঙের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, তিনি প্রজা-কল্যাণের জন্য দিবারাত্র পরিশ্রম করতেন। তাঁর দানশীলতা হিউয়েন সাঙ্কে বিস্মিত করেছিল। প্রজাদের সুবিধার জন্য অশোকের মতই তিনি সরাইখানা, বিশ্রামাগার, দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। ঐতিহাসিক রোলিনসন-এর (Rawlinson) মতে— অশোক ও আকবরকে বাদ দিলে হর্ষবর্ধন ছিলেন ভারতের শ্রেষ্ঠ প্রজাহিতৈষী নরপতি।* ডঃ রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়-এর মতে হর্ষের মধ্যে অশোক ও সমুদ্রগুপ্তের গুণাবলীর এক অপূর্ব সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়।
তথ্য সূত্র:
স্বদেশ পরিচয়- জীবন মুখোপাধ্যায়।