রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত ঐশ্বরিক মতবাদ বা উৎপত্তিবাদ | একাদশ শ্রেণী রাষ্ট্রবিজ্ঞান সাজেশন | Class 11 Political Science Suggestion
ভূমিকা:
রাষ্ট্রের উৎপত্তি বিষয়ক ঐশ্বরিক মতবাদটি প্রাচীনতম মতবাদ। ভারতের প্রাচীন ধর্মশাস্ত্র বিশেষ করে পুরাণে ও মহাভারতের শান্তি পর্বে এই মতবাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই ধরনের মতবাদ প্রকাশ করেন সেন্ট অগাস্টাইন। পরবর্তীকালে রোমান ধর্মযাজক সেন্ট পল, সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাস প্রমুখের লেখায় এই মতবাদের পরিচয় পাওয়া যায়। প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রগুলি সংগত কারণেই ঐশ্বরিক মতবাদের মর্যাদা দাবি করতে পারে। এই মতবাদের মূল বিষয় বা বক্তব্য নীচে আলোচনা করা হল-
মূল প্রতিপাদ্য বিষয়:
ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদ রাষ্ট্রের উৎপত্তিসংক্রান্ত সব থেকে প্রাচীন মতবাদ। এটি এক কল্পনাপ্রসূত মতবাদ। এই মতবাদ অনুসারে-
(১) পৃথিবীতে রাষ্ট্র হল ঈশ্বরের সৃষ্টি। ‘ঈশ্বর স্বয়ং রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন’—এ হল মতবাদের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়।
(২) রাষ্ট্র ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুসারে পরিচালিত হয়। তাঁর ইচ্ছা প্রকাশিত হয় তাঁর প্রতিনিধির মাধ্যমে। রাজাই হলেন ঈশ্বরের মনোনীত প্রতিনিধি।
(৩) রাজার আদেশই হল ঈশ্বরের নির্দেশ। জনগণের কর্তব্য হল দ্বিধাহীন ও প্রশ্নাতীতভাবে রাজার আজ্ঞা মেনে চলা।
(৪) রাজার আদেশ অমান্য করার অর্থ হল ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরোধিতা করা। রাজদ্রোহিতা ধর্মদ্রোহিতার সামিল।
(৫) রাজার কথাই হল আইন।
(৬) রাজার যাবতীয় কার্যকলাপ কল্যাণকর ও ন্যায়সঙ্গত। তিনি দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন করেন।
(৭) রাজপদ বংশানুক্রমিক বা উত্তরাধিকারমূলক।
প্রবক্তা:
প্রাচীনকালে মিশর, জাপান, ভারত প্রভৃতি এশিয়ার বহু দেশে এই মতবাদের বহুল প্রচলন ছিল। হিন্দু পুরাণ অনুসারে বহু রাজারই জন্ম দেবাংশে। মহাভারতে নৃপতিকে ঈশ্বরতুল্য জ্ঞান করতে বলা হয়েছে। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুসারে প্রজাপতি ব্রহ্মা পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন।
খ্রিস্টিয় পঞ্চম শতাব্দীতে সেন্ট অগাস্টাইন ‘City of God’-এই ধারণা প্রচার করেন। রোমান ধর্মযাজক সেন্ট পল, অ্যাকুইনাস প্রমুখ চিন্তাবিদের লেখায়ও ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদের সমর্থন পাওয়া যায়।
সমালোচনা:
গণতান্ত্রিক চিন্তাধারার বিকাশের ফলে অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে মতবাদটির জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মতবাদটির বিরূপ সমালোচনা করা হয়।
১. গণতন্ত্র বিরোধী:
এই মতবাদকে সম্পূর্ণভাবে গণতন্ত্রের বিরোধী বলে রাজাকে ঈশ্বর প্রেরণ করেছেন সেই কারণে রাজাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা জনগণের নেই। যে কারণে রাজাকে আইনের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়েছে, তা অসাম্য ও অগণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা বলে সমালোচকরা মনে করেন।
২. অযৌক্তিক ও অবাস্তব:
ঐশ্বরিক মতবাদকে বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অবাস্তব বলে বর্ণনা করেছে। কারণ এত দক্ষ, যোগ্য পণ্ডিত থাকতে ঈশ্বর কী কারণে রাজাকে প্রতিনিধি করলেন তার কোনো যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা নেই। ঈশ্বর যে রাজাকে প্রতিনিধি করে পাঠিয়েছেন সে বিষয়েও কোনো প্রমাণ নেই। অর্থাৎ, এই মতবাদ অবাস্তব ও কাল্পনিক।
৩. স্বৈরাচারিতার সমর্থক:
ঐশ্বরিক মতবাদ যেভাবে রাজাকে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী করেছে তাতে চরম স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের প্রভাব লক্ষণীয়। রাজার সকল আদেশ, নির্দেশ প্রজাকে মান্য করতে হবে। রাজা তার কাজের জন্য প্রজাদের কাছে দায়ী থাকবেন না। এর ফলে রাজা স্বৈরাচারী হলেও তাকে প্রজাদের মান্য করতে হবে।
মূল্যায়ন:
বহুবিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও মতবাদটির ঐতিহাসিক গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। রাষ্ট্রের উদ্ভবের ক্ষেত্রে ধর্ম একক কারণ না হলেও এক্ষেত্রে ধর্মের একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। ইতিহাসের প্রাথমিক পর্বে মানুষ ছিল একান্ত দুর্বিনীত ও বর্বর। প্রাথমিক স্তরে ধর্মভীতি বা ঈশ্বর চিন্তা মানুষকে আনুগত্য ও সহযোগিতার শিক্ষা দিয়েছে। এইভাবে রাষ্ট্রনৈতিক সংগঠন সৃষ্টির পথ সুগম হয়েছে। আদিম ও অসভ্য মানুষের মনে সচেতন আনুগত্যবোধ দানা বাঁধেনি। এই সময় ধর্মের বহিরাবরণটি মানুষের মনে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের সৃষ্টি করে। গেটেল বলেছেন : ‘মানুষ যখন স্বায়ত্তশাসনের জন্য উপযুক্ত ছিল না তখন এই মতবাদ মানুষকে আনুগত্যের শিক্ষা দান করেছিল’ (“It taught men to obey when they were not yet ready to govern themselves.")।
তথ্য সূত্র:
১. উচ্চমাধ্যমিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রূপরেখা | অনাদিকুমার মহাপাত্র।
২. উচ্চমাধ্যমিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান সহায়িকা | Tallent Booster | ড. চণ্ডীদাস মুখোপাধ্যায়।