আর্য সমস্যা বলতে কী বোঝো | আর্যদের আদি বাসস্থান কী ছিল | আর্য বিতর্ক বলতে কী বোঝ




আর্যদের আদি বাসস্থান সংক্রান্ত বিতর্ক | আর্য সমস্যা | আর্যরা কি বহিরাগত | আর্য সমস্যা টীকা


আর্যদের আদি বাসস্থান : 

আর্যদের আদি বাসস্থান কোথায় ছিল, সে সম্পর্কে পণ্ডিতেরা একমত নন। একদল ঐতিহাসিক মনে করেন যে, ভারতবর্ষই হল আর্যদের আদি বাসস্থান। আবার অপর দলের মতে, ইউরোপ তাদের আদি বাসস্থান। বিভিন্ন পণ্ডিত এ সম্পর্কে মধ্য এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা, স্ক্যান্ডিনেভিয়া নানা মতবাদ ও উত্তর মেরুর কথা বলেছেন।


পণ্ডিত গঙ্গানাথ ঝা, পণ্ডিত লক্ষ্মীধর শাস্ত্রী, পুসলকর, ডঃ ত্রিবেদী, কাল্লা, এ. সি. দাস প্রভৃতি ঐতিহাসিকগণ নানা যুক্তি-তর্কের দ্বারা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, ভারতবর্ষই হল আর্যদের আদি বাসস্থান। এ প্রসঙ্গে তাঁরা মুলতান, কাশ্মীর ও হিমালয়-সংলগ্ন অঞ্চল, পাঞ্জাব প্রভৃতি স্থানের কথা বলেছেন। প্রথমত—তাঁরা বলেন যে, সাধারণত দেশত্যাগী ব্যাক্তিরা দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের ছেড়ে আসা দেশের স্মৃতিচারণ করে থাকেন, কিন্তু ভারতীয় বৈদিক সাহিত্যে এ ধরনের কোন স্মৃতিচারণ নেই।


দ্বিতীয়ত—মূল ইন্দোইওরোপীয় ভাষার সর্বাধিক শব্দ সংস্কৃতে প্রবেশ করেছে এবং এ থেকেই বোঝা যায় যে, মূল ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতের যোগাযোগই বেশী। তৃতীয়ত—বেদের মত উন্নত সাহিত্য পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের আর্যরা সৃষ্টি করতে পারেনি। বলা হয় যে, সমাজের উদ্বৃত্ত লোকগুলি ভারত ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়, কিন্তু মেধাবী আর্যরা ভারতেই থেকে যায়। চতুর্থত— পাঞ্জাব ও সন্নিহিত স্থানের সঙ্গে ঋক্-বেদের ভৌগোলিক বিবরণ মিলে যায়।


এই সব যুক্তির বিরুদ্ধে বলা হয় যে—ভারতই যদি আর্যদের আদি বাসস্থান হয়, তাহলে ভারতের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে না পড়ে কেন তারা বাইরে চলে গেল? দ্বিতীয়ত—উত্তর ভারতের বিভিন্ন অংশ ও সমগ্র দাক্ষিণাত্যে অনার্য সমালোচনা ভাষার অস্তিত্বই প্রমাণ করে যে, আর্যরা বহিরাগত। তৃতীয়ত—সংস্কৃত ভাষায় মূর্ধন্য বর্ণ, যথা—ঋ, ঢ, ঠ, ড, ণ, র, ষ প্রভৃতির আধিক্য আর্য ভাষার ওপর দ্রাবিড় প্রমাণ দেয়। চতুর্থত—এটা প্রমাণিত যে, আর্যরা সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা নয়, সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসকারী।


যে সব পণ্ডিত ইওরোপকে আর্যদের আদি বাসস্থান বলতে চান, তাঁদের মতে—কেবলমাত্র সংস্কৃত ও পারসিক বাদে ‘ইন্দো-ইওরোপীয়’ ভাষাগোষ্ঠীর সাতটির মধ্যে পাঁচটিই ইওরোপে অবস্থিত। দ্বিতীয়ত—প্রচলিত ‘ইন্দো-ইওরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র লিথুয়ানিয়ার ভাষাই প্রত্যক্ষভাবে আর্য ভাষার সঙ্গে যুক্ত—সংস্কৃত নয়। তৃতীয়ত—আদি আর্যরা যে জলবায়ু, জীবজন্তু ও লতা-গুল্মের সঙ্গে পরিচিত ছিল, তা একমাত্র ইওরোপেই মেলে।  


অধিকাংশ পণ্ডিতই আর্যদের আদি বাসস্থান হিসেবে ইওরোপকে মেনে নিয়েছেন—তবে ইওরোপের কোন্ অঞ্চল, সে সম্পর্কেও তাঁদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য আছে। ইওরোপ—আদি বাসস্থান এ সম্পর্কে অধ্যাপক গাইল্স্ (Giles) বলকান উপদ্বীপ বা দক্ষিণ-পূর্ব ইওরোপ, অধ্যাপক হার্ট (Hirt) ভিস্টুলা নদীর অববাহিকা এবং অনেকে জার্মানী ও দক্ষিণ রাশিয়ার কথা বলেছেন। অধ্যাপক ব্রান্ডেনস্টাইন প্রাচীন আর্য ভাষাতত্ত্বের ব্রাণ্ডেনস্টাইন-এর মত আলোচনা করে সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, কোন পর্বতমালার পাদদেশে শুষ্ক ও তৃণাবৃত অঞ্চলই (Steppe) হল তাদের আদি বাসস্থান এবং এই স্থানটি হল উরাল পর্বতের দক্ষিণে অবস্থিত খিরঘিজের তৃণভূমি। এই স্থান থেকে আর্যদের একটি শাখা পশ্চিমে চলে আসে। পরে এই শাখা দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে, একটি ভাগ ইরানে এবং অপরটি ভারতে প্রবেশ করে।


এ মতেরও সমালোচনা হয়েছে। আর্যদের আদি-নিবাস সম্পর্কে গবেষণা আজও চলছে—তবে অধিকাংশ পণ্ডিতই ব্রাণ্ডেনস্টাইন-এর মতকেই আপাতত গ্রহণ করেছেন।


তথ্য সূত্র- 

স্বদেশ পরিচয়- জীবন মুখোপাধ্যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال

×