জায়গীরদারী ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করো | Short Note on Jagirdari System

জায়গীরদারী ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করো

 

জায়গীরদারী ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করো | Short Note on Jagirdari System



আকবর প্রবর্তিত মনসবদারী-প্রথা এবং মোগল আমলের জায়গীরদারী ব্যবস্থা ছিল মোগল শাসনব্যবস্থার মূল ভিত্তি এবং কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের প্রধান হাতিয়ার। এই ব্যবস্থা মানুষের জীবনের গভীরে প্রবেশ করে কেন্দ্রকে শক্তিশালী করে তোলে। মোগলযুগে সকল পদস্থ রাজকর্মচারীই মনসবদার নামে পরিচিত ছিলেন এবং তাঁদের সকলকেই নির্দিষ্ট সংখ্যক সৈন্য ও অশ্ব রেখে বে-সামরিক কাজকর্মের সঙ্গে সঙ্গে কিছু সামরিক কর্তব্যও করতে হত।


মনসবদাররা তেত্রিশটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিলেন এবং তাঁদের সৈন্যসংখ্যার ভিত্তিতেই এই শ্রেণীবিভাগ করা হত। মনসবদার নিয়োগের সর্বময় কর্তা ছিলেন স্বয়ং সম্রাট। যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে মনসবদাররা তাঁদের পদমর্যাদা উন্নত করতে পারতেন। মনসবদার বা রাজকর্মচারীরা সাধারণত নগদ বেতন পেতেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁদের জায়গীর দেওয়া হত। 


যে-সব মনসবদার তাঁদের কাজের বিনিময়ে জায়গীর পেতেন তাঁদের বলা হত ‘জায়গীরদার’ বা ‘তুয়ুলদার'।) মনসবদারের কাছে জায়গীরই অধিকতম কাম্য ছিল, কারণ উত্তম জায়গীর থেকে বেশী অর্থ উপার্জনের সম্ভাবনা থাকত। বেতনের পরিবর্তে তাঁরা তাঁদের জায়গীর থেকে সরকার অনুমোদিত রাজস্ব আদায় করে নিজ ব্যয় নির্বাহ করতেন। তাঁরা কেবলমাত্র সরকার অনুমোদিত রাজস্ব ও অন্যান্য করই আদায় করতে পারতেন—অতিরিক্ত কিছু নয় এবং তা বে-আইনী ছিল। 

নিজ জায়গীরে জায়গীরদারের কোন প্রশাসনিক দায়িত্ব ছিল না বা তিনি সেখানে একচ্ছত্র আধিপত্যও ভোগ করতেন না। তাদের ওপর সরকারী নিয়ন্ত্রণ ছিল কঠোর, সরকারী কর্তৃপক্ষ তাঁদের কাজকর্মের ওপর নজর রাখতেন এবং প্রয়োজনে তাঁদের রাজস্ব-সংক্রান্ত কাগজপত্রও পরীক্ষা করে দেখতেন। জায়গীরের কোন স্থায়ী স্বত্ব ছিল না। প্রতি তিন-চার বছর অন্তর জায়গীরদারকে অন্যত্র বদলী হতে হত।


জায়গীরদারের কোন প্রশাসনিক দায়িত্ব ছিল না বা তিনি সেখানে একচ্ছত্র আধিপত্যও ভোগ করতেন না। তাদের ওপর সরকারী নিয়ন্ত্রণ ছিল কঠোর, সরকারী কর্তৃপক্ষ তাঁদের কাজকর্মের ওপর নজর রাখতেন এবং প্রয়োজনে তাঁদের রাজস্ব-সংক্রান্ত কাগজপত্রও পরীক্ষা করে দেখতেন। জায়গীরের কোন স্থায়ী স্বত্ব ছিল না। 


প্রতি তিন-চার বছর অন্তর জায়গীরদারকে অন্যত্র বদলী হতে হত। বলা বাহুল্য, এই ব্যবস্থা ত্রুটিমুক্ত ছিল না। জমির ওপর জায়গীরদারদের কোন স্থায়ী স্বত্ব না থাকায় তাঁরা কৃষকদের উন্নতির কথা চিন্তা করতেন না এবং নানাভাবে কৃষকদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতেন—এমনকি তাঁরা কৃষক ও তার পরিবারের লোকদের ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রী করতেন। 


বিদেশী পর্যটক মানরিক লিখছেন যে, গ্রামাঞ্চলে কৃষককে বেঁধে বিক্রী করতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, আর তার পেছনে চলেছে তার ক্রন্দনরতা স্ত্রী, কন্যা ও পুত্র—এটা ছিল অতি সাধারণ দৃশ্য। এই প্রথার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ‘জমা’ ও ‘হাসিল’। জমি থেকে কি পরিমাণ রাজস্ব আদায় হবে তার সরকারী হিসাবকে বলা হত ‘জমা’ এবং প্রকৃতপক্ষে যা আদায় হত তার নাম হল ‘হাসিল’। 

জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের আমলে জায়গীরদারের সংখ্যা প্রচুর বৃদ্ধি পায়, কিন্তু জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পায় নি। জাহাঙ্গীর-এর আমল থেকে জমা ও হাসিলের পার্থক্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। নানা প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেও এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয় নি। আয়ের অনিশ্চয়তার দরুন প্রশাসন ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে, ঔরঙ্গজেবের পক্ষে এই ‘জায়গীরদারী সঙ্কট’-এর সমাধান করা সম্ভব হয় নি।


সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে এবং উৎকৃষ্ট জায়গীর লাভের জন্য জায়গীরদারদের মধ্যে রেষারেষি শুরু হয়। শাহজাহান-এর আমলে মনসবদারের সংখ্যা হয় ৭০০০। ঔরঙ্গজেব-এর আমলে এই সংকট তীব্রতর রূপ ধারণ করে। সাম্রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মনসবদারদের সংখ্যা ও প্রশাসনিক ব্যয় বৃদ্ধি পায়, কিন্তু কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায় নি। প্রতিপক্ষের অনেক ব্যক্তিকে দলে টানার উদ্দেশ্যে তিনি তাদের জায়গীর দান করেন। তাঁর আমলে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪,৪৪৯। 

দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ ও মারাঠা আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দাক্ষিণাত্যের অনেক জায়গীরদারই উত্তর ভারতে উর্বর ও নিরাপদ জায়গীর চাইতেন। সরকার এক জায়গীরকে দুই বা ততোধিক টুকরোয় বিভক্ত করে ‘জমা’-র পরিমাণ বৃদ্ধি করে সমস্যা সমাধান করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ‘জমা’ ও ‘হাসিল’-এর মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা সম্ভব হয় নি, সকল জায়গীর-প্রার্থীকে জায়গীর বা মনোমত জায়গীর দেওয়া সম্ভব হয় নি। উৎকৃষ্ট জায়গীরের জন্য রেষারেষি ও দলাদলি শুরু হয়—এমনকি উৎকোচ দেওয়া-নেওয়া শুরু হয়।



তথ্য সূত্র:
স্বদেশ পরিচয়-জীবন মুখোপাধ্যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

World News

نموذج الاتصال

×