মোগল আমলে শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্য | Industry and Trade During the Mughal Period
মোগল আমলে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে নানা পরিচালিত হত। সুলতানী আমলে শিল্পদ্রব্য উৎপাদনের জন্য সরকারী উদ্যোগে বেশ কিছু কারখানা তৈরী হয়েছিল। মোগল আমলে তা আরও সম্প্রসারিত হয়। আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’ থেকে জানা যায় যে, আকবরের উদ্যোগেই এই কারখানাগুলির প্রসার ঘটেছিল এবং তিনি শিল্পোৎপাদন প্রণালীর উন্নতি সম্পর্কে খুবই উৎসাহী ছিলেন। এ জন্য তিনি বিভিন্ন দক্ষ ব্যক্তি নিযুক্ত করেন, যাতে উৎপাদনকারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। বার্নিয়ার-এর রচনা থেকে জানা যায় যে, দিল্লী, লাহোর, আগ্রা, ফতেপুর, আহম্মদাবাদ, বুরহানপুর—এই সব অঞ্চলে এই ধরনের বেশ কিছু কারখানা ছিল। এইসব কারখানায় সরকারের প্রয়োজনীয় সব জিনিসই তৈরী হত।
বিভিন্ন শিল্প:
‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে ভারতের রেশম ও তুলাজাত পণ্য-সামগ্রীর এক দীর্ঘ তালিকা আছে। তুলার চাষ ও বস্ত্র-শিল্প ছিল ভারতের অন্যতম প্রধান শিল্প। বারাণসী, আগ্রা, জৌনপুর, পাটনা, লক্ষ্ণৌ, মালব ও বাংলাদেশ সূতীবস্ত্র উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ছিল। পেলসার্ট লিখছেন যে, পূর্ব বাংলায় সকলেই বস্ত্র বয়ন করে জীবিকা নির্বাহ করত এবং সেখানে যে বস্ত্র তৈরী হত তার গুণ ও খ্যাতি ছিল যথেষ্ট। ঢাকার মসলিন জগদ্বিখ্যাত ছিল এবং পৃথিবীর নানা দেশে তা রপ্তানি হত।
বার্নিয়ার বলেন যে, বাংলায় নানা ধরনের সূতো, রেশমের সূতো ও রেশম বস্ত্র উৎপাদিত হত। তিনি লিখছেন যে, বাংলায় এত বেশী পরিমাণ তুলো ও রেশম আছে যে, এই রাজ্যকে কেবলমাত্র ভারত বা মোগল সাম্রাজ্যের নয়, সমস্ত প্রতিবেশী রাজ্যের—এমনকি ইওরোপেরও, এই দুটো দ্রব্যের ভাণ্ডার বলা যায়। মানুচি বাংলাদেশকে ‘রেশম ভাণ্ডার’ বলে অভিহিত করেছেন। বাংলা, লাহোর, আগ্রা ও গুজরাটে রেশমী বস্ত্র বয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ছিল।
প্রযুক্তিবিদ্যা:
ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব রচিত ‘মধ্যযুগের ভারতে প্রযুক্তিবিদ্যা,' (“Technology in Medieval India') নামক প্রবন্ধ থেকে এই যুগের যন্ত্রবিদ্যার ব্যাপক ও বিস্তৃত পরিচয় পাওয়া যায়। বিহারে প্রচুর পরিমাণে সোরা উৎপন্ন হত, যা দিয়ে যথেষ্ট বারুদ তৈরী হত। দেশের নানা অঞ্চলে ধনী বণিকরা জাহাজ নির্মাণ শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করত। সপ্তগ্রাম, সুরাট, কালিকট প্রভৃতি বন্দরে সমুদ্রগামী ভারী মালবাহী জাহাজ তৈরী হত। ষোড়শ শতকে ভারতীয় কারিগরেরা ব্রোঞ্জ ঢালাই করে ভারী কামান তৈরীতে সাফল্য অর্জন করে। বার্নিয়ারের রচনা থেকে জানা যায় যে, গাদা বন্দুক ও ছরা তৈরীর ক্ষেত্রে ভারতীয়রা যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করে। এই যুগে ‘বান’ নামে এক ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র তৈরী হত। বারুদের মশলা-ভর্তি লোহার সিলিন্ডারে বাঁশের তৈরী ‘বান’ লাগিয়ে ছোঁড়া হত।
অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য:
শান্তি-শৃঙ্খলা, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, সুস্থির মুদ্রানীতি, উন্নত অর্থনৈতিক বিধি-ব্যবস্থা ও নগদ অর্থে বেতনদানের ব্যবস্থা প্রভৃতি কারণে মোগল শাসনাধীনে ভারতে ব্যবসাবাণিজ্যের যথেষ্ট উন্নতি ঘটে। গ্রামে উৎপন্ন দ্রব্যাদি থেকেই সাধারণত গ্রামের মানুষের প্রয়োজন মিটত এবং হাটে মালপত্র বিক্রি হত। গ্রামের উদ্বৃত্ত শস্য শহরে পাঠানো হত। শহরের বাসিন্দারা বাজার থেকে তাঁদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করতেন। এছাড়া, গ্রাম-শহর সর্বত্রই ফেরিওয়ালা ঘুরে ঘুরে মাল বিক্রি করে বেড়াত। দেশের অভ্যন্তরে মাল পরিবহনের জন্য গরুর গাড়ি, ভারবাহী পশু, নৌকা প্রভৃতি ব্যবহৃত হত। উন্নত সড়ক-ব্যবস্থা ও সরাইখানা পণ্য চলাচলে যথেষ্ট সহায়ক হয়।
বৈদেশিক বাণিজ্য:
বিদেশের বাজারেও ভারতীয় পণ্যের বিশেষ চাহিদা ছিল। ইওরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার নানা দেশের সঙ্গে স্থলপথ ও জলপথে ভারতের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ঘনিষ্ঠতর হয়। সুরাট, ব্রোচ, ক্যাম্বে, বেসিন, চৌল, গোয়া, কালিকট, কোচিন, নেগাপট্টম, মসুলিপট্টম, সপ্তগ্রাম, শ্রীপুর, চট্টগ্রাম, সোনারগাঁও এই যুগের বিখ্যাত বন্দর ও বাণিজ্য-কেন্দ্র ছিল। স্থলপথে মুলতান থেকে কান্দাহার এবং লাহোর থেকে কাবুল পর্যন্ত বাণিজ্য চলাচল করত।
ভারত থেকে ইওরোপে সাধারণত নীল, আফিং, সূতীবস্ত্র, মসলিন, চিনি, মোম ও নানা প্রকার মশলা রপ্তানি হত। এছাড়া, অন্যান্য স্থানে চাল, তামাক ও গন্ধক রপ্তানি করা হত। বিদেশ থেকে ভারতে আমদানি করা হত সোনা, রূপা, মূল্যবান মণিমুক্তো, ঘোড়া, নানা প্রকার ধাতু, হাতীর দাঁত, সুগন্ধী দ্রব্য, কাচ, চীনামাটির বাসন, কর্পূর, কার্পেট, গালিচা, ক্রীতদাস প্রভৃতি। পারস্য, তুর্কী, পোল্যান্ড, রাশিয়া, পেগু, মালাক্কা, মিশর প্রভৃতি স্থানে ভারতীয় পণ্যাদির স্থায়ী বাজার সৃষ্টি হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে, এই যুগে মোগল বাদশাহ, প্রাদেশিক শাসনকর্তা এবং মোগল অভিজাতরা বৈদেশিক বাণিজ্যে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন।
ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র-এর গবেষণায় জানা যায় যে, জাহাঙ্গীর, নূরজাহান, শাহজাহান ও ঔরঙ্গজেব এই ধরনের বাণিজ্য চালাতেন এবং তাঁদের বাণিজ্য-জাহাজ ছিল। জাহাঙ্গীর ক্যাম্বের বাণিজ্যে অর্থও বিনিয়োগ করেছিলেন। কোন কোন পণ্যে তাঁরা একচেটিয়া কৰ্তৃত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করতেন। বাংলার শাসনকর্তাদের মধ্যে মীরজুমলা, শায়েস্তা খাঁ, আজিমউস্-শান্ এ ধরনের ব্যবসা চালাতেন।
ভারতীয় পণ্যাদি ইওরোপের বাজারে বিক্রী করে লাভবান হবার জন্য পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, দিনেমার, ইংরেজ, ফরাসী প্রভৃতি বিভিন্ন জাতির ইওরোপীয় বণিকরা ভারতের নানা অঞ্চলে বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করে। বাণিজ্যিক প্রাধান্যলাভের জন্য তাদের মধ্যে বহু সংঘর্ষও হয়। বলা বাহুল্য, বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে এই যুগের শেষ পর্বে ইংরেজ ও ফরাসীরাই এগিয়ে ছিল।
তথ্য সূত্র:
স্বদেশ পরিচয়-জীবন মুখোপাধ্যায়।