হায়দ্রাবাদ কীভাবে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে | How Hyderabad Emerged As a Regional Power

হায়দ্রাবাদ কীভাবে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে

হায়দ্রাবাদ কীভাবে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে | How Hyderabad Emerged As a Regional Power


মীর করমউদ্দিন চিন কিকিচ খাঁ দাক্ষিণাত্যের মোগলশাসিত প্রদেশগুলিকে কার্যত একটি স্বাধীন রাজ্যে পরিণত করেন। তিনি ইতিহাসে নিজাম-উল-মূলক নামে পরিচিত। তাঁর পিতামহ খাজা আবিদ শেখ-উল-ইসলাম ও পিতা গাজীউদ্দিন ফিরোজ জং খ্রিস্টিয় সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি বোখারা থেকে ভাগ্যান্বেষণে ভারতবর্ষে আসেন এবং তাঁরা ঔরঙ্গজেবের প্রশাসনে যোগদান করেন। ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালের শেষ দিকে চিন কিলিচ খাঁ-র রাজনৈতিক উন্নতির সূচনা হয় এবং ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তিনি তুরানী দলের অন্যতম নেতা হয়ে ওঠেন। 


সম্রাট বাহাদুর শাহ তাঁকে অযোধ্যার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। পরে ফারুকশিয়ার সিংহাসনে বসে তাঁকে দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা পদে বসান এবং ‘খান খানন’ ও ‘নিজাম উল-মুলক বাহাদুর ফতে জঙ্গ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। দিল্লীর দরবারে সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের প্রতিপত্তির বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ শুরু হয়, তিনি তাতে নেতৃত্ব দেন। সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের পতনের পর ১৭২০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট মহম্মদ শাহ কৃতজ্ঞতা-স্বরূপ তাঁকে দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। ১

৭২২ খ্রিস্টাব্দে ‘উজিরের’ পদ শূন্য হলে মহম্মদ শাহ তাঁকে ‘উজির’ নিযুক্ত করেন এবং ১৭২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ঐ পদে বহাল ছিলেন। ‘উজির’ পদে আসীন হয়ে তিনি কয়েকটি সংস্কারের কর্মসূচী গ্রহণ করেন, কিন্তু স্বয়ং সম্রাটের বিরোধিতা ও অন্যান্য দুর্নীতিগ্রস্ত আমীর-ওমরাহের ষড়যন্ত্রের ফলে তাঁর সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এতে বিরক্ত হয়ে ১৭২৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি পদত্যাগ করে দাক্ষিণাত্যে ফিরে যান এবং সেখানেই নিজের ভাগ্য গড়ে তুলতে প্রয়াসী হন।


নিজামের এই আচরণে তাঁর শত্রুরা সম্রাট মহম্মদ শাহকে বোঝায় যে, নিজাম বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। এর ফলে সম্রাটের নির্দেশে হায়দ্রাবাদের শাসনকর্তা মুবারিজ খাঁ তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। ১৭২৪ খ্রিস্টাব্দে শকর খেদা-র যুদ্ধে মোগল বাহিনী ধ্বংস হয় এবং মুবারিজ খাঁ নিহত হন। মহম্মদ শাহ সন্ধি স্থাপন করে তাঁকে দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা বলে মেনে নেন এবং তাঁকে ‘আসফ্ জা’ উপাধি দেন।


ঐতিহাসিক আরভিন লেখেন যে, এই সময় থেকেই স্বাধীন হায়দ্রাবাদ রাজ্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তিনি কার্যত: স্বাধীনভাবেই রাজত্ব করতে থাকনে—যদিও তিনি কখনই প্রকাশ্যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন নি। দাক্ষিণাত্যে মারাঠা শক্তি প্রবল হয়ে উঠলে তাঁর সঙ্গে মারাঠাদের সংঘর্ষ বাধে। এসত্ত্বেও দাক্ষিণাত্যের ছয়টি মোগল সুবার ওপর তাঁর কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ণ ছিল। নাদির শাহের ভারত আক্রমণকালে মহম্মদ শাহের আহ্বানে তিনি নাদির শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেন এবং যুদ্ধের পরে শান্তি স্থাপনেও তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।


শাসক হিসেবেও তাঁর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাঁর পরিচালনাধীনে হায়দ্রাবাদ ভারতের মুসলিম রাজ্যগুলির মধ্যে অগ্রণী হয়ে ওঠে। হিন্দুদের ক্ষেত্রে তিনি সহনশীলতার নীতি গ্রহণ করেন এবং যোগ্যতাসম্পন্ন হিন্দুদের তিনি উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত করতেন। তাঁর ‘দেওয়া’’ ছিলেন হিন্দু পূরণচাঁদ। তিনি বিদ্রোহী জমিদারদের দমন করেন, মারাঠা আক্রমণ প্রতিহত করেন, রাজস্ব-ব্যবস্থাকে দুর্নীতিমুক্ত করার প্রয়াস চালান এবং রাজ্যের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনে সক্ষম হন। 


ইংরেজ ও ফরাসী বণিকরা তাঁর সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলত এবং তাঁর জীবদ্দশার এই দুই বণিক সংগঠন নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে পারে নি। সমকালীন মুসলিম ঐতিহাসিকরা দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা হিসেবে তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয় কিন্তু এই রাজবংশ আরও দুইশ' বছর ধরে দাক্ষিণাত্যের এক বৃহৎ অংশ শাসন করে।


তথ্য সূত্র:

স্বদেশ পরিচয়-জীবন মুখোপাধ্যায়।


 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

World News

نموذج الاتصال

×