ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি সম্পর্কে আলোচনা করো | Aurangzeb Deccan policy

ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি

 ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি | ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি সম্পর্কে আলোচনা করো



১৬৮১ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের মধ্যে উত্তর ভারতের সমস্যাগুলিকে মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে এনে সেপ্টেম্বর মাসে ঔরঙ্গজেব সমস্যা সংঙ্কুল দাক্ষিণাত্যে যাত্রা করেন। দাক্ষিণাত্যের উদীয়মান মারাঠা শক্তি, বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার সংগে মারাঠা রাজ্যের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এবং ঔরঙ্গজেবের পুত্র আকবরের বিদ্রোহ ও মারাঠা দরবারে তাঁর আশ্রয় গ্রহণ ঔরঙ্গজেবের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে ওঠে। এই রাজ্য দু'টি জয় করা এবং মারাঠাদের দমনের জন্য তিনি তাঁর জীবনের শেষ ছাব্বিশ বছর দাক্ষিণাত্যে অতিবাহিত করেন। বলা বাহুল্য, দাক্ষিণাত্যেই তাঁর নিজের ও তাঁর সাম্রাজ্যের সমাধি রচিত হয়।



শাহজাহানের রাজত্বকালে দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা থাকাকালে ঔরঙ্গজেব বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা রাজ্যদু’টি জয় করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু দারা ও জাহানারার বিরোধিতা এবং শাহজাহানের হস্তক্ষেপে তা সম্ভব হয় নি। নিজে সিংহাসনে বসার পর উদীয়মান মারাঠা শক্তিকে দমন এবং বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা রাজ্য দু'টি জয়ের জন্য তিনি জয়সিংহ, দিলীর খাঁ, যশোবন্ত সিং ও শাহজাদা আজমকে দাক্ষিণাত্যে পাঠান। 

তাঁদের পক্ষে দাক্ষিণাত্যে কোন সাফল্য লাভ করা সম্ভব হয় নি। শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত শাসকদের অধীনস্থ বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা জয়ের পশ্চাতে সাধারণত ঔরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতিকে দায়ী করা হয়, কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকদের অনেকে এর পশ্চাতে নানা অর্থনৈতিক, সামরিক ও শাসনতান্ত্রিক কারণের উল্লেখ করেছেন। 


দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর তিনি বিজাপুর (১৬৮৬ খ্রিঃ) এবং গোলকুণ্ডা (১৬৮৭ খ্রিঃ) জয় করেন। এ ছাড়া, ১৬৯৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাঞ্জোর ও ত্রিচিনোপল্লীর হিন্দু রাজ্য দু'টি জয় করেন। এইভাবে তাঁর শাসনকালে মোগল সাম্রাজ্য সর্বোচ্চ আকৃতি ধারণ করে, কিন্তু এই বিশালতার মধ্যেই ধ্বংসের বীজ নিহিত ছিল। সিংহাসনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে ঔরঙ্গজেব তাঁর মাতুল শায়েস্তা খাঁ -র ওপর শিবাজীকে দমনের দায়িত্ব অর্পণ করেন (১৬৬০ খ্রিঃ)। 

প্রাথমিক কিছু সাফল্যের পর লাঞ্ছিত শায়েস্তা খাঁ কোনক্রমে প্রাণ নিয়ে দাক্ষিণাত্য ত্যাগ করেন (১৬৬৩ খ্রিঃ)। এরপর সুদক্ষ সেনাপতি জয়সিংহ ও দিলীর খাঁ-কে পাঠান হয়। তাঁরা শিবাজীকে পুরন্দরের সন্ধি (১৬৬৫ খ্রিঃ) স্বাক্ষরে বাধ্য করেন। সন্ধির শর্ত অনুসারে শিবাজী (১) মোগল সার্বভৌমত্ব স্বীকার করেন,


(২) ২৩টি দুর্গ ও কয়েকটি জেলা—যেখান থেকে বার্ষিক ২০ লক্ষ টাকা রাজস্ব আদায় হতে পারে, মোগলদের ছেড়ে দেন, (৩) তাঁর পুত্র শম্ভুজী মোগল দরবারে ৫ হাজারী মনসবদার নিযুক্ত হন, এবং (৪) বিজাপুরের বিরুদ্ধে মোগলদের সাহায্য দানে সম্মত হন। সন্ধি সম্পাদনের কিছুদিন পরেই জয়সিংহের অনুরোধে শিবাজী শিশুপুত্র শম্ভুজী-সহ আগ্রায় যান (১৬৬৬ খ্রিঃ)। 


সেখানে তাঁকে আগ্রা দুর্গে নজরবন্দী করে রাখা হয়। সুচতুর শিবাজী শিশুপুত্রসহ কৌশলে সেখান থেকে পলায়ন করে নিজ রাজ্যে ফিরে আসেন। তাঁকে কোন ভাবেই পরাজিত করা সম্ভব নয় দেখে ঔরঙ্গজেব তাঁকে ‘রাজা’ বলে স্বীকার করেন এবং জায়গীর হিসেবে বেরার দান করেন। দাক্ষিণাত্যে মোগল সেনাপতিদের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে বিদ্রোহ দমনে সম্রাটের ব্যস্ততার সুযোগে ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে শিবাজী মোগলদের বিরুদ্ধে পুনরায় যুদ্ধ শুরু করেন। 

পুরন্দরের সন্ধির শর্ত হিসেবে যে ২৩টি দুর্গ তিনি মোগলদের ছেড়ে দিয়েছিলেন, সেগুলি একে একে তিনি পুনরুদ্ধার করেন। ১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে ‘ছত্রপতি’ ও ‘গো-ব্রাহ্মণ প্রতিপালক’ উপাধি ধারণ করে রায়গড় দুর্গে মহাসমারোহে তিনি নিজ অভিষেক সম্পন্ন করেন।


শিবাজীর মৃত্যুর পর ১৬৮০ খ্রিঃ তাঁর পুত্র শম্ভুজী মারাঠা রাজ্যের সিংহাসনে বসেন। পিতার সামরিক প্রতিভা তাঁর ছিল না। ১৬৮৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি মোগল বাহিনীর হস্তে বন্দী হন এবং তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়। এরপর মোগল-বাহিনী বহু মারাঠা দুর্গ—এমনকি রাজধানী রায়গড় দখল করে। রায়গড় দখলকালে শম্ভুজীর শিশুপুত্র শাহু ও পরিবারের অন্যান্যরাবন্দী হন। শম্ভুজীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা রাজারাম কোনক্রমে পলায়ন করে কর্ণাটকে আশ্রয় গ্রহণ করেন। 


শম্ভুজীর মৃত্যুর পর মারাঠা সংগ্রাম নতুন রূপ ধারণ করে এবং প্রকৃত অর্থেই ‘জনগণের যুদ্ধ’ শুরু হয়। রাজারামের নেতৃত্বে মারাঠারা মোগলদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। রাজারামের মৃত্যুর পর তাঁর বিধবা-পত্নী তারাবাঈ শিশুপুত্র তৃতীয় শিৰাজীকে সিংহাসনে বসিয়ে মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাতে লাগলেন। মারাঠা-বাহিনী দাক্ষিণাত্যের মোগল অধিকৃত অঞ্চলগুলিতে অতর্কিত আক্রমণ চালাতে লাগল। 

মোগল বাহিনী আত্মরক্ষামূলক নীতি গ্রহণে বাধ্য হল। দীর্ঘ দুই দশক ধরে যুদ্ধ চালিয়েও ঔরঙ্গজেব মারাঠাদের বিরুদ্ধে কোন সাফল্য অর্জন করতে পারলেন না। দেহ-মনে রিক্ত নব্বই বছরের বৃদ্ধ বাদশার ক্লান্ত আত্মা শেষ পর্যন্ত ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দের ৩রা মার্চ আহম্মদনগরের মাটিতে চিরশান্তি লাভ করল। দাক্ষিণাত্যই হল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের দেহ ও সাম্রাজ্যের সমাধিস্থল।


তথ্য সূত্র:

স্বদেশ পরিচয়- জীবন মুখোপাধ্যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

World News

نموذج الاتصال

×