ভূমিকা:
দিল্লীর সুলতানদের মধ্যে আলাউদ্দিন খলজি (১২৯৬-১৩১৬) ছিলেন ঘোরতর সাম্রাজ্যবাদী শাসক এবং তিনিই ছিলেন ভারতে মুসলিম সাম্রাজ্যবাদের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। স্যার উলস্লী হেগ-এর মতে, আলাউদ্দিনের রাজত্বকাল থেকেই সুলতানী সাম্রাজ্যবাদের যুগের সূচনা হয়।
সাম্রাজ্যবাদের সূচনা:
ইলতুৎমিসের আমল থেকে দিল্লী সুলতানীর আয়তন বৃদ্ধির বিশেষ কোন চেষ্টা হয় নি, কিন্তু আলাউদ্দিন সাম্রাজ্য বিস্তারের কাজে সাফল্যমণ্ডিত হন। সিংহাসন আরোহণের পূর্বে তাঁর পিতৃব্যের শাসনকালেই তিনি ভিসা (১২৯২ খ্রিঃ) ও দেবগিরি (১২৯৬ খ্রিঃ) লুণ্ঠন করে তাঁর সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের পরিচয় দেন। ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র বলেন যে, তাঁর আমলে যে রাজ্যজয় নীতির সূচনা হয়, পরবর্তীকালেও তা অব্যাহত থাকে এবং মহম্মদ বিন তুঘলকের আমলে তা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। ঘোরতর সাম্রাজ্যবাদী আলাউদ্দিন আলেকজান্ডারের মত বিশ্ববিজেতা হবার স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর মুদ্রা থেকে জানা যায় যে, তিনি ‘সিকন্দর-ই-সানি’ বা ‘দ্বিতীয় আলেকজান্ডার’ উপাধি ধারণ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত দিল্লীর বিজ্ঞ কোতোয়ালের পরামর্শে তিনি বিশ্বজয়ের পরিকল্পনা ত্যাগ করে ভারত জয়ে মনোনিবেশ করেন।
রাজ্যজয়ের উদ্দেশ্য:
দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন অংশে যুদ্ধাভিযান চালিয়ে তিনি এক বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্য স্থাপনে সক্ষম হন। কেবলমাত্র সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব, আগ্রাসী নীতি বা ধন-সম্পদ সংগ্রহ করাই নয়— তাঁর রাজ্যজয়ের পশ্চাতে আরও কিছু উদ্দেশ্য ছিল। রাজপুতনার রণথম্বোর, চিতোর প্রভৃতি স্থানের দুর্গগুলির ওপর উত্তর ভারতের নিরাপত্তা বহুলাংশে নির্ভর করত। সুলতান শাহীর নিরাপত্তার খাতিরে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজপুতদের হাত থেকে এই স্থানগুলি দখল করা অপরিহার্য ছিল।
গুজরাট ও মালবের বন্দরগুলির সঙ্গে বহির্বিশ্বের বাণিজ্যিক যোগাযোগ চলত এবং বহির্বাণিজ্যের ফলে এই স্থানগুলি ছিল ঐশ্বর্যশালী। এই স্থানগুলির উর্বর ভূমিতে কৃষি-উৎপাদনের পরিমাণও ছিল প্রচুর। সামরিক প্রয়োজনে যে ঘোড়ার দরকার হত তাও বিদেশ থেকে গুজরাটের বন্দরে আসত। এই সব কারণে মালব ও গুজরাট দখল করা তার কাছে অপরিহার্য ছিল। এ ছাড়া, দিল্লী ও গুজরাটের মধ্যে যোগাযোগের পথগুলি ছিল রাজপুতানার ওপর দিয়ে। সুতরাং কেবলমাত্র সাম্রাজ্যবাদী স্পৃহাই নয়—রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণেও তিনি উত্তর ভারতে অভিযান প্রেরণ করেন। তাঁর দক্ষিণ ভারত আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল সাম্রাজ্যবিস্তার ও ধন-রত্ন লুণ্ঠন।
উত্তর ভারত জয়:
উত্তর ভারতে তিনি গুজরাট (১২৯৭ খ্রিঃ), রণথম্বোর (১২৯৯-১৩০১ খ্রিঃ), মেবার (১৩০৩ খ্রিঃ), মালব, মাণ্ডু, উজ্জয়িনী, চান্দেরী, ধার (১৩০৫ খ্রিঃ) মাড়ওয়ার (১৩০৮ খ্রিঃ) ও জালোর (১৩১১ খ্রিঃ) জয় করেন। ১২৯৭ খ্রিস্টাব্দে উলুঘ খাঁ ও নসরৎ খাঁ-র নেতৃত্বে রাজ্যজয়ের উদ্দেশ্যে তিনি গুজরাট-এর বিরুদ্ধে প্রথম অভিযান পাঠান। গুজরাটের রাজা কর্ণদেবের পত্নী রাণী কমলা দেবী সুলতানী সেনার হাতে বন্দিনী হন। এসময় মালিক কাফুর নামে এক দাসকে বন্দী করে দিল্লীতে আনা হয় এবং এই মালিক কাফুরই পরে আলাউদ্দিনের প্রধান মন্ত্রী ও সেনাপতি পদে উন্নীত হন। গুজরাট থেকে তিনি প্রভূত ধনরত্ন অর্জন করেন। এরপর রাজপুতনার রণথম্বোর জয় করেন।
রাণা হামির দেব তাঁর পরিবারবর্গসহ নিহত হন। এরপর তিনি মেবারের রাজধানী চিতোর আক্রমণ করেন। কথিত আছে যে, চিতোরের রাণা রতন সিংহের পরমাসুন্দরী পত্নী পদ্মিনীকে লাভ করার জন্যই আলাউদ্দিন মেবার জয়ে প্রণোদিত হন। বর্তমানে প্রমাণিত হয়েছে যে, এই কাহিনীর কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। যাই হোক, প্রবল প্রতিরোধের পর চিতোর পরাজিত হয় এবং রাজপুত রমণীগণ ‘জহর ব্রত’ পালন করে অগ্নিতে আত্মবিসর্জন দেন। এইভাবে কাশ্মীর, নেপাল ও আসাম ব্যতীত সমগ্র উত্তর ভারতে তাঁর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। উত্তর ভারতের রাজ্যগুলি সরাসরি দিল্লীর অধীনে আনলেও রাজপুত রাণারা কার্যত স্বাধীনভাবেই রাজত্ব করতেন এবং তাঁরা সুলতানকে নিয়মিত কর দিতেন ও সুলতানের আদেশ মেনে চলতেন।
দক্ষিণ ভারত জয়:
দিল্লীর সুলতানদের মধ্যে তিনিই প্রথম দাক্ষিণাত্যে অভিযান পাঠান। তাঁর এই দাক্ষিণাত্য অভিযানে নেতৃত্ব দেন মালিক কাফুর। তিনি একে একে দাক্ষিণাত্যের দেবগিরি রাজ্যের যাদববংশীয় রাজা রামচন্দ্র (১৩০৬–০৭ খ্রিঃ এবং ১৩১৩ খ্রিঃ), বরঙ্গল-এর কাকতীয় বংশীয় রাজা প্রতাপ রুদ্র (১৩০৮-১০ খ্রিঃ), দ্বারসমুদ্র-এর হোয়েসল বংশীয় রাজা তৃতীয় বীর বল্লাল (১৩১০ খ্রিঃ) এবং পাণ্ড্য রাজ্য (১৩১১ খ্রিঃ) জয় করে দক্ষিণে সেতুবন্ধ রামেশ্বর পর্যন্ত অগ্রসর হন। বলা বাহুল্য, এই সব রাজ্যগুলি থেকে তিনি প্রচুর ধনরত্ন সংগ্রহ করেন। আমীর খসরু-র মতে, পরাজিত মালিক কাফুর পাণ্ড্য রাজ্য থেকে ২৭৫০ পাউন্ড সোনা, বহু মণিমুক্তা, ৫ হাজার ঘোড়া ও ৫১২টি হাতি দিল্লীতে পাঠিয়েছিলেন। বরণী বলছেন যে, পাণ্ড্য রাজ্য থেকে লুণ্ঠিত সোনা, মণিমুক্ত ও ধনরত্ন এক হাজার উটের পিঠে চড়িয়ে মালিক কাফুর যখন দিল্লীতে প্রবেশ করছিলেন তখন ধন-রত্নের ভারে ক্লান্ত উটগুলি কাতরভাবে আর্তনাদ করছিল। দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলিকে তিনি কেবলমাত্র করদ রাজ্যেই পরিণত করেন—সুলতানী শাসনাধীনে আনেন নি, কারণ তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, সুদূর দিল্লী থেকে দাক্ষিণাত্যের ওপর আধিপত্য বজায় রাখা সম্ভব নয়। এইভাবে তিনি উত্তর ও দক্ষিণ ভারতকে এক রাজশক্তির অধীনে আনয়ন করে দিল্লীর সুলতানী সাম্রাজ্যকে একটি ‘সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য’-এ পরিণত করেন।
তথ্য সূত্র:
স্বদেশ পরিচয় | জীবন মুখোপাধ্যায়।