ভূমিকা:
সাহিত্য, সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধর্ম, স্থাপত্য-ভাস্কর্য ও শিল্পের ইতিহাসে পাল-সেন যুগ এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। এই যুগে সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতীয় মনীষার এক অপূর্ব বিকাশ পরিলক্ষিত হয়।
পাল যুগে সাহিত্যের বিকাশ:
বাংলা সাহিত্য:
পালযুগে সংস্কৃত, মাগধী-প্রাকৃত ও শৌরসেনী অপভ্রংশ —– এই তিন ধরনের ভাষার প্রচলন ছিল। মাগধী-প্রকৃত ও শৌরসেনী অপভ্রংশের মিশ্রণে বাংলা ভাষার আদি-রূপের উদ্ভব হয়। এই আদি-রূপকে চর্যাপদ বলা হয়। লুইপাদ, কাহ্নপাদ প্রভৃতি বৌদ্ধধর্মাচার্যদের রচিত চর্যাপদগুলি হল বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নমুনা। এরই প্রভাবে পরবর্তীকালে বাংলায় সহজিয়া গান, বাউল গান ও বৈষ্ণব পদাবলীর সূচনা হয়।
সংস্কৃত সাহিত্য:
পালযুগে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের প্রভূত উন্নতি দেখা যায়। সংস্কৃত রচনার ক্ষেত্রে এক নতুন রীতির উদ্ভব ঘটে, যা সম্পূর্ণভাবে বাংলার নিজস্ব। তার নাম ‘গৌড়ীয় রীতি’। কাব্য, ব্যাকরণ, অলংকারশাস্ত্র, ছন্দশাস্ত্র, ধর্মতত্ত্ব, নাটক, গদ্য-সাহিত্য প্রভৃতি সর্বক্ষেত্রেই বহু গ্রন্থাদি রচিত হয়। পালযুগের বিখ্যাত পণ্ডিত কেশব মোর বৈদিক সাহিত্য, মীমাংসা, তর্কশাস্ত্র ও বেদান্তে সুপণ্ডিত ছিলেন। ন্যায়কন্দরী, অদ্বয়সিদ্ধি প্রভৃতি দর্শন ও অধ্যাত্ম-চিন্তা সম্পর্কিত পাঁচটি গ্রন্থের রচয়িতা শ্রীধর, ন্যায়শাস্ত্রের পণ্ডিত অভিনন্দ, প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ বৈয়াকরণিক মৈত্রেয়-রক্ষিত, জিনেন্দ্রবুদ্ধি, সর্বানন্দ, শরণদেব, প্রখ্যাত পণ্ডিত ও রাজনীতিজ্ঞ ভবদেব ভট্ট, ‘দায়ভাগ’ রচয়িতা জীমূতবাহন এবং ‘রামচরিত’ রচয়িতা সন্ধ্যাকর নন্দী এযুগেই আবির্ভূত হন।
সেন যুগে সাহিত্যের বিকাশ:
সংস্কৃত সাহিত্যের ক্ষেত্রে সেন শাসনকাল ‘সুবর্ণযুগ'। হিন্দুশাস্ত্রে সুপণ্ডিত সেনরাজা বল্লাল সেন রচিত 'দানসাগর’ ও ‘অদ্ভুতসাগর’ হিন্দু আচার-অনুষ্ঠান ও দানকর্মাদি বিষয়ে এক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। তাঁর পুত্র লক্ষ্মণ সেন একজন সুকবি ছিলেন। তিনি পিতার অসমাপ্ত গ্রন্থ ‘অদ্ভুতসাগর’ সমাপ্ত করেন। বল্লাল সেনের গুরু অনিরুদ্ধ ভট্ট লিখিত ‘হারলতা’ ও ‘পিতৃদয়িতা’ নামক গ্রন্থ দু'টিতে হিন্দুদের বিবিধ অনুষ্ঠান ও নিত্যকর্মের বিস্তৃত আলোচনা আছে। সেযুগের বেশ কিছু কৃতী পণ্ডিত ও কবি সেনরাজাদের রাজসভা অলংকৃত করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ছিলেন হলায়ুধ। তাঁর রচিত ‘ব্রাহ্মণ-সর্বস্ব’ গ্রন্থে হিন্দুদের আহ্নিক ও বৈদিক মন্ত্রাদির ব্যাখ্যা আছে।
তথ্য সূত্র:
১. স্বদেশ পরিচয় - জীবন মুখোপাধ্যায়।