আকবরের রাজপুত নীতির পরিচয় দাও | Rajput policy of Akbar

আকবরের রাজপুত নীতির পরিচয় দাও | Rajput policy of Akbar

আকবরের রাজপুত নীতির পরিচয় দাও | Rajput policy of Akbar | মোগল সম্রাট আকবরের রাজপুত নীতি 


ভারতবর্ষ তথা বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় সম্রাট আকবর এক শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করে আছেন। তিনি তাঁর নানা আদর্শ ও কার্যকলাপের মাধ্যমে নিজের নাম ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করে গেছেন। সম্রাট আকবর সাম্রাজ্যবাদী নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মনে করতেন যে, " একজন রাজা সর্বদাই রাজ্য বিস্তারে সচেষ্ট থাকবেন, নতুন তাঁর প্রতিবেশীরা তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবে।" - তবে আকবর রাজপুতদের ক্ষেত্রে এই নীতি গ্রহণ করেননি। 

ঐতিহাসিকদের মতে, আকবর শুধুমাত্র একজন শ্রেষ্ঠ সম্রাট হিসেবেই দায়িত্ব পালন করেননি, একজন শ্রেষ্ঠ কূটনীতিবিদ হিসেবে তিনি বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ছিল আকবরের রাজপুত নীতি।


ঐতিহাসিকরা মনে করেন, সম্রাট আকবর ছিলেন সুদক্ষ একজন রাষ্ট্রনীতিবিদ। তাই, তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, ভারতবর্ষের বুকে মোগল সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখতে হলে রণনিপুন রাজপুতদের সাহায্যের প্রয়োজন। রাজপুতরাই একমাত্র শৌর্যে ও বীর্যে উত্তর ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতি ছিল - একথাও আকবর ভালোভাবেই বুঝতে পারেন। তাই তিনি রাজপুতদের সঙ্গে শত্রুতার পরিবর্তে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলে মুঘল সাম্রাজ্যকে শক্তিশালী করে তুলতে উদগ্রীব হন।


আকবর রাজপুতদের সঙ্গে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিকানির অম্বররাজ বিহারীমলের রাজকন্যা মণিবাঈকে বিবাহ করেন। তিনি বিহারীমলকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দান করে মৈত্রী স্থাপন করেন। নিজপুত্র সেলিমের সঙ্গে ভগবান দাসের কন্যার বিবাহ দিয়ে আকবর হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের এক নতুন যুগের সূচনা করেন। অবশ্য কোনো কোনো ঐতিহাসিক আকবরের এই বৈবাহিক নীতিকে 'বিশেষ উদ্দেশ্যসাধনের যন্ত্র' হিসেবে দেখিয়েছেন।


আকবর রাজপুতদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জনের উদ্দেশ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাৎসরিক এক কোটি টাকা আয়ের 'হিন্দু তীর্থযাত্রী কর' এবং ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে মুসলমান উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের বিরোধিতা সত্ত্বেও জিজিয়া কর তুলে দেন। শুধু তাই নয়, আকবর রাজপুতদের কয়েকটি মর্যাদা সম্পন্ন সুযোগও দান করেন। যেমন- 

a. যুদ্ধবন্দী হিসেবে ক্রীতদাস করার রীতি নিষিদ্ধ করেন। 

b. 'দেওয়ান ই আমে' রাজপুতদের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়েই প্রবেশের অনুমতি দেন। 

c. রাজপুতদের ঘোড়াগুলিকে ' দাগ' চিহ্নে চিহ্নিত করার থেকে অব্যাহতি দেন।


রাজপুতদের তথা হিন্দুদের মন জয় করার উদ্দেশ্যে আকবর সংস্কৃত ভাষার উৎকর্ষের আগ্রহী হন। তিনি হিন্দু পণ্ডিতদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সমাদর পোষণ করতেন। হিন্দুধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের আলোচনা তিনি ইবাদতখানায় সাগ্রহে শ্রবণ করতেন। 

এমনকি রাজপুতদের তথা হিন্দুদের সার্বজনীন আতিথ্য গ্রহণের উদ্দেশ্যে আকবর কপালে 'তিলক ' কেটে রাজদরবারে বসতেন এবং শিবরাত্রিতে সাধু সন্ন্যাসীদের সঙ্গে একত্রে পান-ভোজন করতেন। সম্রাট আকবরের একটি স্থায়ী নির্দেশ ছিল, ধর্মের জন্য কাউকে উৎপীড়িত করা চলবে না। এই ধর্মীয় সহিষ্ণুতার জন্য গোঁড়া মুসলমান সম্প্রদায় আকবরের প্রতি বিরূপ হয়েছিলেন।



তবে আকবর যে, সকল ক্ষেত্রেই বিনাযুদ্ধে রাজপুতদের বিষয়ে সফলকাম হয়েছিলেন একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় না। ১৫৬২ খ্রিঃ মালব, ১৫৬৮ খ্রিঃ রণথম্ভোর, ১৫৭০ খ্রিঃ মাড়োয়ার, বিকানীর এবং জয়সলমীর রাজ্যের বিরুদ্ধে তাঁকে অস্ত্রধারণ করতে হয়। এইভাবে বেশ কিছু রাজপুত-রাজ্য আকবরের অধীনে আসে। 

তবে মেবার দীর্ঘকাল আকবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধাবস্থা চালিয়ে যাচ্ছিল। অবশ্য একদিন মেবারের রাজধানী চিতোরের পতন হয়। অপরাপর অঞ্চলগুলির মধ্যে প্রতাপগড় ডুগারপুর ক্রমে আকবরের অধীনে আসে। তবে কখনোই সংকীর্ণ প্রতিহিংসাপরায়ণতা আকবরের মানসিকতাকে আচ্ছন্ন করেনি।


আকবরের উদার রাজপুত নীতি নানা দিক থেকে মোগল সাম্রাজ্যে তাৎপর্যপূর্ণতা বহন করেছিল। আকবরের আনুগত্য স্বীকার করে নেওয়ার ফলে রাজপুত রানারা স্বাধীনভাবে নিজ নিজ রাজ্যের শাসনকাজ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাদের কর্মদক্ষতা ও আনুগত্যের স্বীকৃতি হিসেবে রাজপুতদের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক-পদে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। যেমন- অম্বরের ভগবান দাসকে লাহোরের যুগ্ম-শাসক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। 

মানসিংহ প্রথমে কাবুল এবং পরে বাংলা-বিহারের শাসনকর্তার পদ লাভ করেন। এইভাবে অন্যান্য রাজপুতদের আগ্রা, গুজরাট, আজমীর প্রভৃতি প্রদেশের শাসক নিযুক্ত করা হয়। সর্বোপরি, সম্রাটের প্রিয়পাত্র ও আত্মীয়তার  সূত্রে রাজপুতগন মোগল দরবারের সম্মান ও প্রতিপত্তির অধিকারী হতে পেরেছিলেন। এই কারণে ঐতিহাসিক টড যথার্থই মন্তব্য করেছেন, " আকবর ছিলেন রাজপুতানার প্রথম সফল বিজেতা, যিনি সোনার শিকল দিয়ে গর্বিত রাজপুতদের বাঁধতে পেরেছিলেন।"


তথ্য সূত্র:

১. মুঘল রাজ থেকে কোম্পানি রাজ- অধ্যাপক গোপালকৃষ্ণ পাহাড়ী।

২. মাধ্যমিক ইতিহাস শিক্ষক- জি. কে. পাহাড়ী।

৩. স্বদেশ পরিচয়- জীবন মুখোপাধ্যায়।


 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

World News

نموذج الاتصال

×