চীনে বক্সার বিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র | History Honours

চীনে বক্সার বিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র | History Honours

 চীনে বক্সার বিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র | History Honours


১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে জাপানের হাতে চীনের শোচনীয় পরাজয়, ১৮৯৭-৯৮ খ্রিস্টাব্দ - নাগাদ বিভিন্ন পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কর্তৃক চীনের বিভাজন, চীনাদের  প্রতি খ্রিস্টান মিশনারীদের দুর্ব্যবহার প্রভৃতি ঘটনার হিংস্র প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হয়েছিল ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের বক্সার বিদ্রোহের মধ্যে। ঐতিহাসিক জ্যাক গ্রে বলেছেন, বক্সার বিদ্রোহীদের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিদেশীদের চীন থেকে বিতাড়িত করা। ঐতিহাসিক জাঁ শোনো বলেছেন, বক্সার অভ্যুত্থান ছিল চীনাদের একটি জাতীয়তাবাদী  প্রতিক্রিয়া এবং খ্রিস্টান মিশনারী ও ধর্মান্তরিত চীনা খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে জেহাদ।  তাছাড়াও, শোনো বলেছেন, এটি ছিল গুপ্ত সমিতির নেতৃত্বাধীন একটি কৃষক নিম বিদ্রোহ। ফেয়ারব্যাঙ্কের মতে, চীনা জনজীবনে যে গভীর সংকট দেখা দিয়েছিল  বক্সার বিদ্রোহ ছিল তার বিরুদ্ধে এক প্রত্যক্ষ সংগ্রাম (The Boxer movement emerged as a direct action response to a deepening crisis, in the lives of the whole Chinese people.)।


১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে বক্সার বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী যে সমস্ত ব্যক্তি বেঁচে ছিলেন তাঁদের নিয়ে চীনে একটি সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। এই সমীক্ষা অনুযায়ী দেখা ও যায় যে, বিদ্রোহীদের প্রায় ৭০ শতাংশ এসেছিলেন কৃষক পরিবার থেকে। এঁরা অধিকাংশই ছিলেন ক্ষেতমজুর এবং এঁদের বয়স ছিল অত্যন্ত কম (সাধারণত ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সের মধ্যে)। তাছাড়া, নৌকার মাঝি, ফেরিওয়ালা, কুলি, কর্মচ্যুত হস্তশিল্পী, ছোট দোকানদার, স্কুলশিক্ষক প্রভৃতিরাও এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, বিদ্রোহীদের অধিকাংশই ছিলেন দরিদ্র শ্রেণীর লোক। তবে পিকিং-এর রাজসভা যখন থেকে বক্সারদের সমর্থন করতে থাকে, তখন প্রচুর রাজপুরুষ এবং জেস্ট্রির সদস্যরা বক্সারদের মদত দিয়েছিলেন।


খ্রিস্টধর্মের বিরোধিতা এবং বিদেশী বিরোধিতা ছিল বক্সার বিদ্রোহের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। প্রথমদিকে অবশ্য এই বিদ্রোহ ছিল একই। সাথে চিং রাজবশে-বিরোধী এবং বিদেশী-বিরোধী। তখন বিদ্রোহীদের স্লোগান ছিল- "চিং বংশকে উৎপাটিত কর এবং বিদেশীদের খতম কর" (Overthros the Ching and annihilate the foreigners)। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই যখন চীনের রাজসভা, বিশেষত বিধবা রানী (Empress dowager) বিদ্রোহীদে মদত দেন তখন থেকেই বক্সার বিদ্রোহীরা চিং রাজবংশের সমর্থক হয়ে ওঠেন।  তখন তাঁরা স্লোগান দিয়েছিলেন-'চিং বংশকে সমর্থন কর এবং বিদেশীদের গেজে কাসে কর' (Support the Ching and destroy the foreigners)। 

প্রথম থেকেই বিদেশী বিরোধিতা প্রসঙ্গে বক্সারদের একটি সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এবং যতদিন বিদ্রোহ চলেছিল ততদিন পর্যন্ত তাঁদের এই দৃষ্টিভঙ্গি অপরিবর্তিত ছিল। এব বিদ্রোহ আরম্ভ হবার সাথে সাথে বিদ্রোহীরা টেলিগ্রাফ এবং রেললাইন পল ধ্বংস করেন এবং বহুসংখ্যক খ্রিস্টান গীর্জায় এবং ইউরোপিয়দের বাসস্থানে এর অগ্নিসংযোগ করেন। তাছাড়া, বিদ্রোহীরা মিশনারী এবং ধর্মান্তরিতদের নির্বিচারে হত্যা করেছিলেন।


প্রকৃতপক্ষে বক্সার বিদ্রোহীদের কোন উন্নতমানের সামাজিক কর্মসূচী ছিল না। তাছাড়া, একটি বিদ্রোহকে সফল করার জন্য যে সাংগঠনিক দক্ষতার প্রয়োজন সে ধরনের কোন দক্ষ সংগঠনও বক্সারদের ছিল না। সেই দিক থেকে তাইপিং বিদ্রোহীদের থেকে তাঁরা অনেকটাই পিছিয়ে ছিলেন। তাই একদল ইউরোপিয় ঐতিহাসিক বক্সার বিদ্রোহকে "উন্মত্ত গোঁড়ামির" (Mad fanaticism) দ্বারা পরিচালিত একটি "প্রতিক্রিয়াশীল" (Reactionary) অভ্যূত্থান হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। 


কিন্তু ঐতিহাসিক ইস্রায়েল এস্টেইন এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলেছেন, এই অভ্যুত্থানকে "প্রতিক্রিয়াশীল" হিসাবে আখ্যায়িত করা অমার্জিত সাম্রাজ্যবাদী কুৎসা ছাড়া কিছুই নয় (Nevertheless, it is a crude imperialist libel to call the movement reactionary.)। তাঁর মতে চীনের সাধারণ 'মানুষ একদল সংস্কৃতিবোধ সম্পন্ন দস্যু (Cultured robbers), যারা তাদের দেশকে ভাগ করে গ্রাস করতে চেয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন বক্সার মধ্য দিয়ে। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ঐতিহাসিকরাও বক্সার বিদ্রোহকে দেশপ্রেমিক চীনাদের 'সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম' হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

World News

نموذج الاتصال

×