মোগল সাম্রাজ্যের পতনে জায়গীরদারী সংকট কতটা দায়ী ছিল | Jaigirdari Crisis


জায়গীরদারী সংকট বলতে কি বোঝ | মোগল সাম্রাজ্যের পতনে জায়গীরদারী সংকট কতটা দায়ী ছিল | Jaigirdari Crisis 


মোগল সম্রাট আকবরের আমল থেকে মূল্যবান ও অতিরিক্ত জায়গীর লাভের আশঙ্কা মোঘল অভিজাতদের মধ্যে গোষ্ঠীগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংঘর্ষ সৃষ্টি করে যা, সামগ্রিকভাবে সমগ্র মোগল সাম্রাজ্যের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। মোগল আমলের এই ঐতিহাসিক সমস্যা জায়গীরদারী সংকট নামে পরিচিত। 


মোগল সম্রাট শাহজাহানের আমল থেকে জায়গীরদারী ব্যবস্থার যৌগিক রূপান্তর ঘটে। জাকির ব্যবস্থার প্রশাসনিক চরিত্র দ্রুত পাল্টে গিয়ে কূটনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। ঔরঙ্গজেবের আমলে এই বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন জায়গীর ব্যবস্থার ভারসাম্য বিনষ্ট করে। তার আমলে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং বিদ্রোহী জমিদার ও প্রজারা খাজনা বন্ধ করে দিলে রাজস্বের পরিমাণ কমতে থাকে। ঐতিহাসিক মোরল্যান্ড মন্তব্য করেছেন, " ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে দেশ যে দেউলিয়া, তা স্পষ্ট হয়ে উঠল।"


ঔরঙ্গজেবের রাজত্বের শেষদিকে জায়গীরদারী ব্যবস্থা প্রবল সংকটের সম্মুখীন হয়। যদিও এই সংকটের সূত্রপাত হয়েছিল জাহাঙ্গীরের আমলেই। জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের আমলে মনসবদারদের সংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায় এবং এই সময় থেকেই কাগজে-কলমে দেখানোর রাজস্ব (জমা) ও আদায়কৃত প্রকৃত রাজস্বের (হাসিল) মধ্যে ফারাক দেখা দিতে শুরু করে। এছাড়াও ঔরঙ্গজেবের রাজত্ব হলে মনসবদারদের সংখ্যা প্রচুর বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বন্টনযোগ্য জমির পরিমাণ সেই তুলনায় বৃদ্ধি পায়নি। এছাড়াও যুদ্ধবিধ্বস্ত অশান্ত দাক্ষিণাত্য থেকে জায়গীরদাররা কখনোই পুরোপুরি রাজস্ব আদায় করতে পারতো না।


জায়গীর পাওয়ার জন্য মনসবদারদের মধ্যে দলাদলি চরমে ওঠে। জাতি ও ধর্মের সুপ্ত মনোভাব জাগিয়ে তোলা হয় এবং অভিজাত সম্প্রদায় থেকে হিন্দুদের বিতাড়নের জিগির তোলা হয়। দক্ষিণী অভিজাতদের দলে টানার জন্য ঔরঙ্গজেব তাদের মনসব দিয়েছিলেন, কিন্তু নিম্নমানের মনসব পাওয়ায় তারাও বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছিল। উত্তর ভারতে উন্নতমানের জায়গীর পাওয়ার জন্য সকলেই দরবারের নিজ নিজ প্রভাব বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হয়- এমনকি সম্রাটকে পর্যন্ত প্রভাবিত করার চেষ্টা শুরু হয়। দরবারে অবাধে উৎকোচ দেওয়া নেওয়া শুরু হয়। বলা বাহুল্য, এতে দলাদলিই বৃদ্ধি পায়। জায়গীর না পাওয়ায় বা নিম্নমানের জায়গীর পেয়ে "জমা" ও "হাসিল" - এর মধ্যে সামঞ্জস্য না হওয়ায় সাম্রাজ্যে নানা দুর্নীতি ও অনাচার দেখা দেয় এবং এর ফলে সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে।


জায়গীর জমিতে ' ইজারা' প্রথায় প্রবর্তন জায়গীর ব্যবস্থার সংকটকে তীব্রতর করে তোলে। যেসব জায়গীরদার ঘনঘন বদলি হতেন, তাদের পক্ষে প্রাপ্য প্রাপ্য রাজস্ব আদায় করাটা কিছুটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। ইজারা ব্যবস্থার ফলে জমিদার ও কৃষক উভয়ের ওপর অতিরিক্ত আর্থিক চাপ পড়ে এবং কৃষিকার্যে বিঘ্ন অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। সাদিক খানের বিবরণী হতে জানা যায়, শাহজাহানের রাজত্বকালে ইজারাদারদের চাপে ভাগ্যান্বেষী অর্থলোভী বেনিয়া মনোভাবাপন্ন ইজারাদারগণ বনেদী জমিদার ও কৃষক শ্রেণীর সর্বনাশ সাধন করে জায়গীর ব্যবস্থার মৌলিক চরিত্র ও লক্ষ্যকে এমনভাবে রূপান্তরিত করে যে, মোগল সাম্রাজ্যের ভিত্তিমূলে কাঁপন ধরিয়ে দেয়।


মনসবদার নিয়োগ জায়গীর বরাদ্দ, পদোন্নতি অথবা পদচ্যুতি সবই নির্ভর করত সম্রাটের মর্জির ওপর। তাই জায়গীরদাররা সম্রাটের প্রতি আনুগত্য দেখাতেন। এখানে ব্যক্তিগত আনুগত্যই ছিল প্রধান। কোন জাতীয়, রাষ্ট্রীয় বা ধর্মীয় আনুগত্য বিকাশলাভ করেনি। সম্রাট ও শাসকশ্রেণীর মধ্যে ছিল 'পৃষ্ঠপোষক ও ভোক্তার' সম্পর্ক। জায়গীর সংকট সেই সম্পর্কের ভিত্তিমূলে আঘাত করে। সম্রাট বণ্টনযোগ্য নতুন জমি উদ্ধার করে ও উদ্ভূত সংকট মেটাতে পারতেন। কিন্তু ঔরঙ্গজেবের রাজত্বের শেষদিকে নতুন এলাকা দখল বা উদ্ধারের উদ্যোগে ভাটা পড়েছিল। ফলে সম্রাটের প্রতি জায়গীরদার আনুগত্যে শৈথিল্য প্রকট হয় এবং দরবারে অভিজাতদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মুঘল প্রশাসনের প্রাণশক্তি হরণ করে নেয়।


তথ্য সূত্র:

১. মাধ্যমিক ইতিহাস শিক্ষক | জি. কে. পাহাড়ী।

২. স্বদেশ পরিচয় | জীবন মুখোপাধ্যায়।

৩. মুঘল-রাজ থেকে কোম্পানী-রাজ | অধ্যাপক গোপালকৃষ্ণ পাহাড়ী।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

World News

نموذج الاتصال

×