বাজীরাও -এর হিন্দু পাদ পাদশাহী আদর্শ | Hindu Pad Padshahi Ideal of Bajirao
১৭২০ খ্রিস্টাব্দে পেশোয়া বালাজী বিশ্বনাথের মৃত্যু হলে তাঁর উনিশ বছর বয়স্ক পুত্র প্রথম বাজীরাও ‘পেশোয়া’ পদ লাভ করেন। বহু গুণের অধিকারী প্রথম বাজীরাও ছিলেন সমরকুশল সাহসী যোদ্ধা, দক্ষ প্রশাসক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ। ক্রীড়া, অশ্বারোহণ ও সংস্কৃত শাস্ত্রে তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ছিল।
ঐতিহাসিক গ্রান্ট ডাফ তাঁকে ‘মারাঠা জাতির নেপোলিয়ন’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর সম্বন্ধে বলা হয় যে, শিবাজীর পরেই তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ গেরিলা যুদ্ধবিশারদ। তাঁর আমলেই মারাঠারা সর্বপ্রথম সর্বভারতীয় রাজনীতি ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে।
মোগল সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের ওপর তিনি এক সর্বভারতীয় মারাঠা সাম্রাজ্য স্থাপনে প্রয়াসী হন। তিনি মনে করতেন যে, মোগল সাম্রাজ্যের ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। তিনি শাহুকে বোঝাবার চেষ্টা করেন যে, “মৃতপ্রায় শুষ্ক বৃক্ষের কাণ্ডে আঘাত করলেই বৃক্ষের শাখাপ্রশাখাগুলি আপনা থেকেই খসে পড়বে। এভাবেই মারাঠা পতাকা কৃষ্ণা নদী থেকে সিন্ধু নদ পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ডে উড্ডীন হবে।”
বলাবাহুল্য, সকল মারাঠা নেতৃমণ্ডলী পেশোয়ার এই যুক্তি মানতে রাজী ছিলেন না। অনেকে উত্তর ভারতে অভিযান প্রেরণের পূর্বে দাক্ষিণাত্যে মারাঠা আধিপত্য বিস্তারের পক্ষপাতী ছিলেন। অনেকে আবার রাজ্য বিস্তারের পরিবর্তে মারাঠা রাজ্যকে শক্তিশালী ও সুসংহত করার কথা বলেন। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত মারাঠা অধিপতি শাহু তাঁকে সমর্থন জানান এবং তিনি একটি সর্বভারতীয় মারাঠা সাম্রাজ্য বিস্তারে উদ্যোগী হন। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য হিন্দু-
রাজন্যবর্গের সাহায্য লাভের আশায় তিনি ‘হিন্দু-পাদপাদশাহী’ বা মারাঠা নেতৃত্বে হিন্দু সাম্রাজ্য স্থাপনের আদর্শ ঘোষণা করেন। বিভিন্ন রাজপুত রাজা ও জমিদারেরা তাঁর প্রতি সমর্থন জানায়। প্রথমে তিনি দাক্ষিণাত্যে নিজাম-এর বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। পরাজিত নিজামের সংগে এক গোপন চুক্তি দ্বারা স্থির হয় যে, দাক্ষিণাত্যের মোগল সুবাগুলি থেকে চৌথ ও সরদেশমুখী আদায় করা ব্যতীত মারাঠারা সেখানে আর কোন উপদ্রব করবে না।
এর বিনিময়ে মারাঠাদের উত্তর ভারত অভিযানের সময় নিজাম নিরপেক্ষ থাকবেন। ১৭২৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি মালব আক্রমণ করলে হিন্দু জমিদারগণ তাঁকে নানাভাবে সাহায্য করেন। এর অল্পকাল পরে সমৃদ্ধশালী গুজরাট রাজ্যে এক গৃহবিবাদের সুযোগে বাজীরাও অতি সহজেই সেখানে মারাঠা আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেন। বুন্দেলখণ্ড-র অধিপতি ছত্রশালের সংগে মোগলদের সংঘর্ষ চলছিল।
১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে বাজীরাও বুন্দেলখণ্ড আক্রমণ করে ছত্রশালের পক্ষে মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং মোগল শাসনকর্তা মহম্মদ শাহকে বিতাড়িত করেন। ‘হিন্দু-পাদ-পাদশাহী’-র আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছত্রশাল প্রকাশ্য দরবারে বাজীরাও-কে সম্বর্ধনা জানান, তাঁকে চৌথ দানে সম্মত হন এবং রাজ্যের একাংশ তাঁকে সমর্পণ করেন। অম্বর-রাজ দ্বিতীয় জয়সিংহের সংগে তাঁর প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি দিল্লীর উপকণ্ঠে হাজির হন। ভীত সম্রাট মহম্মদ শাহ মারাঠাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার আশায় দাক্ষিণাত্যে নিজাম-উল-মুল্ক-কে সংবাদ পাঠান। ভূপালের যুদ্ধ (১৭৩৮ খ্রিঃ)-তে পরাজিত হয়ে নিজাম সন্ধি-স্বাক্ষরে বাধ্য হন।
সন্ধির শর্ত অনুসারে নিজাম যুদ্ধের ব্যয় বাবদ পেশোয়াকে ৫০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেন এবং নর্মদা থেকে চম্বল পর্যন্ত সমগ্র ভূভাগে পেশোয়ার কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেন। এইভাবে উত্তর ভারতে প্রথম স্বাধীন মারাঠা রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। নিজামের পরাজয়ের পর মারাঠা সেনা দিল্লীর কাছে যমুনা তীরে উপনীত হয়, কিন্তু পেশায়ার নির্দেশে দিল্লীতে প্রবেশ করে নি। এর পরের বছর (১৭৩৯ খ্রিঃ) বাজীরাও-ভ্রাতা চিমন্জী আপ্পারাও-এর নেতৃত্বে মারাঠা সেনাবাহিনী পর্তুগীজ-দের পরাজিত করে ভারতের পশ্চিম উপকূলে সল্সেট ও বেসিন দখল করে।
এই সময় ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের অধিপতি নাদির শাহ-র ভারত আক্রমণের সংবাদ প্রচারিত হলে, মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার্থে তিনি প্রতিবেশী মুসলিম রাষ্ট্রগুলির সংগে সন্ধি স্থাপন করে নাদির শাহের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে প্রয়াসী হন। বলা বাহুল্য, এর পূর্বেই ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৪২ বৎসর বয়সে অকস্মাৎ এই অন্যতম শ্রেষ্ঠ মারাঠা রাজনীতিবিদের জীবনদীপ নির্বাপিত হয়।
তথ্য সূত্র:
স্বদেশ পরিচয়-জীবন মুখোপাধ্যায়।