খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক | প্রতিবাদী ধর্মীয় আন্দোলনের কারণ
ভূমিকা:
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক ভারতে ধর্মীয় আলোড়নের যুগ হিসেবে চিহ্নিত। এই যুগে বৈদিক ধর্মের বিরুদ্ধে নানা প্রতিবাদ দেখা দেয় ও বহু নতুন ধর্মমতের উদ্ভব হয়। বৌদ্ধগ্রন্থ অনুসারে এই যুগে ভারতে তেষট্টি-টি প্রতিবাদী ধর্মের উত্থান ঘটে। জৈনগ্রন্থে এর সংখ্যা আরও বেশী বলে উল্লিখিত হয়েছে। এই সব ধর্মমতের মধ্যে জৈন ও বৌদ্ধধর্ম সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
১. ধর্মীয় কারণ:
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের বহু পূর্বেই বৈদিক ধর্ম তার সরলতা ও পূর্ব গৌরব হারিয়ে ফেলে। ব্যয়বহুল যাগ-যজ্ঞ, পশুবলি, দুর্বোধ্য ক্রিয়াকাণ্ড ও অনুষ্ঠানসর্বস্বতা, ধর্মীয় কার্যে ব্রাহ্মণ-পুরোহিতদের অপরিহার্যতা এবং এর ফলে সমাজে তাঁদের প্রতিপত্তি ও ক্রমবর্ধমান দক্ষিণার চাহিদা প্রভৃতির ফলে ধর্ম প্রাণহীন হয়ে পড়ে এবং সমাজে এক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বৈদিক সমাজের চতুরাশ্রম প্রথার ব্রহ্মচর্য ও গার্হস্থ্যাশ্রমে মানুষের আপত্তি ছিল না, কিন্তু বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাসের আদর্শ সবার কাছে গ্রহণীয় ছিল না। অপরদিকে, উপনিষদে যাগযজ্ঞ অপেক্ষা আত্মার মুক্তি, কর্মফল ও স্বাধীন চিন্তার আদর্শ প্রচারিত হতে থাকে।
২. সামাজিক কারণ:
বৈদিক সমাজের মধ্যেই ধর্মবিপ্লবের বীজ নিহিত ছিল। বৈদিক সমাজ স্পষ্টতই চারটি বর্ণে বিভক্ত ছিল। সমাজে ব্রাহ্মণদের মর্যাদা ছিল সবার ওপরে। সমাজ ও রাষ্ট্রে তাঁরা বহু সুযোগ-সুবিধা পেতেন। তাঁরা রাজার কাছ থেকে নানা উপহার পেতেন, তাঁদের কোন কর দিতে হত না—এমন কি অনেক সময় তাঁরা শাস্তিরও ঊর্ধ্বে ছিলেন। ব্রাহ্মণদের পরেই ছিল ক্ষত্রিয়দের স্থান। তাঁরা ছিলেন যোদ্ধা ও শাসকশ্রেণীর মানুষ। তাঁরা যুদ্ধ করতেন, রাজকার্য পরিচালনা করতেন ও রাজস্ব আদায় করতেন। এই যুগে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের মর্যাদা বৃদ্ধি পেলেও বৈশ্যদের মর্যাদা হ্রাস পায় এবং অনেক সময় তাদের শূদ্রদের সঙ্গে এক করে দেখা হত।
৩. অর্থনৈতিক কারণ:
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে নতুন ধর্মচিন্তার উন্মেষে উত্তর-পূর্ব ভারতের গাঙ্গেয় উপত্যকার নতুন কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। উত্তর উত্তর-প্রদেশ এবং উত্তর ও দক্ষিণ বিহার-সহ সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারত ছিল ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে লোহার হাতিয়ারের সাহায্যে বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে এই অঞ্চলে কৃষিকার্য শুরু হয় এবং নতুন উপনিবেশ স্থাপিত হতে থাকে। কৃষিকার্যের নতুন পদ্ধতি ও উন্নত সারের ব্যবহারের ফলে কৃষির ফলন খুব বৃদ্ধি পায়।
৪. নতুন কৃষি অর্থনীতি:
এইসময় গ্রামাঞ্চলে ‘গহপতি’ নামে বৈশ্য সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত এক বিত্তশালী কৃষক সম্প্রদায়ের উৎপত্তি হয়। এই কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির জন্য পশুপালন অপরিহার্য। আবার বৈদিক ধর্মরীতিতেও বলিদান ছিল অপরিহার্য ও স্বাভাবিক। একমাত্র অশ্বমেধ নতুন কৃষি অর্থনীতি যজ্ঞেই ৬০০ ষাঁড় বধ করা হত। বলা বাহুল্য, এসবই কৃষিকার্যের পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এছাড়া, মগধের দক্ষিণ ও পূর্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে বসবাসকারী উপজাতীয় গোষ্ঠীর মানুষরা খাদ্যের জন্য নিয়মিতভাবে পশু হত্যা করত। সুতরাং নতুন এই কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিকে স্থায়ী করার জন্য নির্বিচারে পশুহত্যা বন্ধ করা প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে।
এই সময় ব্যক্তিগত সম্পত্তি, ধন-সম্পদের প্রাচুর্য, আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাত্রা, উন্নত মানের পোশাক, পরিবহন ও বাসস্থান এক শ্রেণীর মানুষের মনে প্রবল বিতৃষ্ণার সঞ্চার করেছিল। বিলাসময় এই জীবনযাত্রা ত্যাগ করে তারা পূর্বের সহজ, সরল ও তপশ্চর্যাময় জীবনে ফিরে যেতে চাইছিল। বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম বিলাসিতার দিক পরিহার ও তপস্বীর জীবনযাত্রার কথা প্রচার করে মানুষের এই চাহিদাও মিটিয়েছিল।
জৈন ও বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের সোনা-রূপা স্পর্শের অধিকার ছিল না। শরীর ও আত্মাকে তৃপ্ত রাখার জন্য যতটুকু প্রয়োজন, তাঁরা ঠিক ততটুকুই গ্রহণ করতে পারতেন। অধ্যাপক ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বলছেন যে, এই যুগে কৃষিকার্য ও ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের ফলে একশ্রেণীর মানুষের হাতে প্রচুর সম্পদ জড়ো হয় এবং অপর শ্রেণীর অবস্থা ক্রীতদাসের পর্যায়ে নেমে আসে। সমাজের বৃহত্তর অংশের লোকরা ছিল দরিদ্র, বঞ্চিত ও নিপীড়িত।